দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর অবহেলিত
বন্দরনগরীর আগ্রাবাদে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হতে পারতো, যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করত।
যদিও জাদুঘরটি চালু হয়েছে আজ থেকে ৪৮ বছর আগে, কিন্তু সরকারি গেজেটে তালিকাভুক্ত প্রায় অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির কোনো প্রতিনিধিত্ব এখানে নেই।
জরাজীর্ণ ভবনের ছাদের বিভিন্ন স্থানে পলেস্তরা খসে যাওয়ায় হলরুম ও গ্যালারিগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। কর্মীরা জানান, বর্ষায় বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে হলের কক্ষ ও গ্যালারির অমূল্য জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মী বলেন, হলের কক্ষ এবং গ্যালারির বেশিরভাগ বাতিই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নতুন বাতি প্রতিস্থাপন করা হয়নি, ফলে দর্শকদের জাদুঘরে রাখা জিনিসগুলি দেখতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
চারটি গ্যালারিসহ ১১টি কক্ষ বিশিষ্ট জাদুঘরের প্রদর্শনীগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টিসহ দেশের ২৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির জীবনধারা ও সংস্কৃতি তুলে ধরে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিগুলো হলো: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, চাক, তংচঙ্গ্যা, মুরং, খুমি, গারো, বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, মনিপুরী, খাসিয়া, ওরাওঁ, হাজং, মান্দাই, ডলু, হোদি, বোনা, পোলিয়া, কোচ, রাজবংশী, সাঁওতাল, মুন্ডা ও হো।
উল্লেখ্য, সরকার ২৩ মার্চ, ২০১৯-এ একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশে মোট ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি তালিকাভুক্ত করেছে কিন্তু নৃতাত্বিকদের মতে দেশে প্রায় ৭৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি বসবাস করে।
তার মানে, সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত প্রায় অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব জাদুঘরে অনুপস্থিত।
এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রুবেল মজুমদার নামের একজন দর্শনার্থী বলেন, জাদুঘরে সরকারি তালিকাভুক্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেকরই প্রতিনিধিত্ব নেই, যোগ করে বলেন, 'ভেতরে আলো এত কম যে প্রদর্শনীর বস্তুগুলি ভালোমতো দেখা কষ্টসাধ্য।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'সরকার ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিকে তালিকাভুক্ত করলেও দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মোট সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ৭৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি রয়েছে।'
'দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে আমাদের এইসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে হবে, অন্যথায় দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণে বিঘ্ন ঘটবে,' বলেন তিনি।
নৃতাত্ত্বিক জাদুঘরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের পোশাক, প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিস, বাদ্যযন্ত্র, অলঙ্কার, অস্ত্র, ছবি, এবং বিভিন্ন মূর্তি ও দেবতার আইকনসহ প্রায় ২৭০০টি বস্তু প্রদর্শন করা হচ্ছে।
জাদুঘরের একজন কর্মচারী মিনতি বড়ুয়া বলেন, তিনি ত্রিশ বছর ধরে সেখানে কাজ করছেন। তিনি জাদুঘরে আগত দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করার কাজটি উপভোগ করেন।
তিনি বলেন, শীত মৌসুমে জাদুঘরে অনেক বিদেশি দর্শনার্থী আসেন।
জাদুঘরে প্রবেশ ফি ২০ টাকা হলেও স্কুলের শিক্ষার্থীরা পাঁচ টাকায় জাদুঘরে প্রবেশ করতে পারে। সপ্তাহে রবিবার বন্ধ থাকে।
জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের কিপার ড. আতাউর রহমান বলেন, ফান্ড সংকটের কারণে তারা হলঘরে নতুন বাতি প্রতিস্থাপন করতে পারেননি।
ঝুঁকিপূর্ণ ছাদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাদুঘর ভবন সংস্কারের জন্য তিনি প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন।
আতাউর জানান, তিনি গত ১৭ জুন জাদুঘরে যোগদান করেন এবং তারপর থেকে তিনি দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের সম্পর্কে যাতে সাধারণ মানুষ এবং ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারে সেজন্য তাদেরকে জাদুঘরে যেতে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য ছাত্র ও শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানাতে আমি প্রায় ৪০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি,' তিনি বলেন।
জাদুঘরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বাস বরাদ্দ করা হলে তা জাদুঘরের প্রচারে সহায়ক হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'জাতীয় জাদুঘরে শিক্ষার্থীদের বহন করার জন্য বাস আছে।'
যোগাযোগ করা হলে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, একটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে দেশের সমস্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত।
'আমি জাদুঘরটি সংস্কার করার জন্য একটি প্রকল্প শুরু করার জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেব যার অধীনে জাদুঘরে সমস্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে এবং ভবনটিও সংস্কার করা হবে,' তিনি বলেন।
Comments