আমরা কেন কাজ ফেলে রাখি?

আমাদের প্রত্যেকটা দিন শুরু হয় নতুন কিছুর আশায়। কেউ ভাবে আজ থেকে ধূমপান করবে না, কেউ ভাবে লেখাপড়ায় মনোযোগ দেবে, আবার কারো ভাবনায় থাকে—সময়মতো কাজ শেষ করা। কিন্তু কিছু বদ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন! এগুলো আমাদের পিছু ছাড়তেই চায় না! এই যেমন কাজ ফেলে রাখার অভ্যাস, দিনের পর দিন কাজ জমিয়ে রাখে।
এভাবে ইচ্ছে করে কাজ ফেলে রাখা বা দেরি করার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এই অভ্যাস বা স্বভাবকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছে প্রোক্রাস্টিনেশন।
প্রোক্রাস্টিনেশন কী?
আপনি জানেন, একটি কাজ করতে হবে। কাজটা দরকারি, গুরুত্বপূর্ণ—তাও বোঝেন। কিন্তু মন বারবার বলে, 'পরে করব, এখন নয়।' ব্যস, কাজটা আর করা হয় না! দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যায়—কিন্তু কাজটা আর ধরা হয় না। কিংবা অর্ধেক করেই ফেলে রাখা হয়। এটাকেই বিজ্ঞান বলছে প্রোক্রাস্টিনেশন।
এটা কখন হয়?
ধরুন, আপনাকে একটি ইমেল পাঠাতে হবে, একটি রিপোর্ট জমা দিতে হবে, কিংবা হাঁটতে বের হতে হবে—এই সাধারণ কাজই অনেক সময় পাহাড়সম মনে হয়। তখন সহজ উপায় হয়ে দাঁড়ায়, কাজটা না করে ফেলে রাখা।
বিজ্ঞান বলছে, এর পেছনে আমাদের চিন্তা ও অনুভূতি দায়ী। যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফুশিয়া সিরোইস বলেন, 'প্রোক্রাস্টিনেশনের মূল কারণ কাজ নয়, বরং সেই কাজটি করতে গিয়ে যে ভয় বা অস্বস্তি তৈরি হয়—আমরা সেটাকেই এড়িয়ে চলি।'
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—আপনাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে বলা হলো। ওই বিষয়ে আপনি ভালো জানেন, কিন্তু আত্মবিশ্বাস নেই। তখন বুঝতে পারেন না কীভাবে শুরু করবেন। তাই মনে ভয় আসে, 'না জানি ঠিক লিখছি কি না', 'ভুল করলে কী হবে?' এই ভয় থেকেই সেই লেখাকে টেনে নিয়ে যান কাল, পরশু বা পরের সপ্তাহে।
সিরোইস বলেন, প্রোক্রাস্টিনেশন হলো সময়মতো কাজ না করা বা দেরি করা। যার পেছনে কোনো বাস্তব কারণ নেই। মানে আপনি ইচ্ছা করে দেরি করছেন। আপনি জানেন কাজটা দরকারি, এটাও জানেন সময়মতো না করলে সমস্যা হবে—তবু করছেন না।
কীভাবে মস্তিষ্ক এতে ভূমিকা রাখে?
২০২১ সালে একদল বিজ্ঞানী একটি গবেষণায় দেখেন, যেসব শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের বাম ডোরসোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশে বেশি ধূসর পদার্থ (গ্রে ম্যাটার) আছে, তারা কম প্রোক্রাস্টিনেট করে। এই অংশটি আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ কন্ট্রোলের সঙ্গে যুক্ত।
যাদের এই অংশ সক্রিয়, তারা সহজে ভয় বা দুশ্চিন্তা সামলে নিতে পারে। তারা কাজ শেষ করতে পারে এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানের অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠে।
কিন্তু যাদের এই অংশ দুর্বল, তারা এখনকার অস্বস্তি থেকে বাঁচতেই কাজ ফেলে রাখে। এমনকি সেই কাজের জন্য বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও ফেলে রাখে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে অ্যামিগডালা। এটি আমাদের মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা মূলত ভয়, আবেগের সঙ্গে যুক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি প্রোক্রাস্টিনেট করে, তাদের অ্যামিগডালা বড় হয়। এর মানে তারা খুব ছোট ছোট বিষয়েও ভয় পায়। যেমন 'এই ইমেলটা লিখবো কীভাবে?' এই ভয় থেকে দূরে থাকতে চায় বলেই কাজটা ফেলে রাখে।
প্রোক্রাস্টিনেশন কি জন্মগত?
সিরোইস বলেন, হ্যাঁ, কিছুটা প্রোক্রাস্টিনেশনের পেছনে জিনের প্রভাব থাকে। যেমন, আমাদের মধ্যে কারো কারো স্বভাবগতভাবে বেশি ইম্পালসিভনেস বা হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা থাকে। সেটা থাকলে কাজ ফেলে রাখার ঝুঁকিও বাড়ে।
তবে তার মানে এই না, তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত বদলাতে পারবেন না। এসবের পেছনে পরিবেশ, জীবনযাপন, মানসিক অবস্থাও বড় ভূমিকা রাখে। যেমন কেউ হয়তো খুবই দায়িত্বশীল, কিন্তু হঠাৎ পরিবারের কারো মৃত্যু, সম্পর্কের টানাপড়েন বা দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি তার মনের ওপর বাড়তি চাপ ফেলতে পারে। ফলে তিনি আর কাজ করতে পারেন না। তখন কাজ ফেলে রাখা হয়, ভালো থাকার মানসিক কৌশল। যেটা খুবই সহজ উপায় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।
প্রভাব কী?
প্রোক্রাস্টিনেশন থেকে সৃষ্টি হয়—মানসিক চাপ, ঘুমের সমস্যা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, লেখাপড়ায় খারাপ ফল, চাকরির সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট। তাই প্রোক্রাস্টিনেশনকে মজার বা তুচ্ছ বলে ভাবার সুযোগ নেই। বরং এটি একটা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যার সমাধান প্রয়োজন।
কীভাবে বের হবেন এই ফাঁদ থেকে?
সিরোইস বলেন, প্রথম কাজ হলো নিজের আবেগ বুঝতে পারা। আপনি যদি কোনো কাজ শুরু করতে না পারেন, তাহলে মাথা ঠান্ডা রাখুন। তারপর ভাবুন—এখন কেমন লাগছে, কাজটা কেন অস্বস্তিকর লাগছে, কী নিয়ে ভয় পাচ্ছেন।
এরপর কাজটাকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে নিন। একদম ছোট ধাপ; যেমন, শুধু এক লাইন লিখুন, ফাইলটা খুলে দেখুন, আবার একটু লিখুন—এভাবে শুরু করলে ভয়টা কমে যায়। কাজ শেষ হলে নিজেকে মূল্যায়ন করুন, পছন্দের খাবার খান, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আর সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, কাজ যেমনই হোক না কেন নিজেকে দোষারোপ করবেন না।
সিরোইস বলেন, 'যদি আপনি আগের প্রোক্রাস্টিনেশনকে ক্ষমা করতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে কাজ ফেলে রাখার প্রবণতা অনেক কমাতে পারবেন।'
প্রোক্রাস্টিনেশন বাস্তব, বিজ্ঞানসম্মত ও সমাধানযোগ্য সমস্যা। এটি অলসতা নয়, বরং আমাদের আবেগ, ভয় ও মানসিক চাপের কারণে হয়। নিজেকে বুঝতে পারা, ছোট ছোট পদক্ষেপ নেওয়া ও নিজের প্রশংসার মাধ্যমে আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স
Comments