‘পুলিশ নিয়ে হামলাকারীরা বাড়িতে ঢোকে, সবই তো পুলিশ জানে’

শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমানের বাড়িতে হামলা হয়। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের কৈরাব এলাকায় গতকাল শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পুলিশের সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন মাসুদ।

আজ রোববার ভুলতায় মাসুদুরের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে বাইরে থেকে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল, বাড়ির প্রধান ফটকের সামনের মেঝেতে বসে আহাজারি করছেন মাসুদুরের বড় ভাইয়ের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। 

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'আমি কোনো রাজনীতি করি না, আমি সাধারণ মানুষ। যা আছিল সব নিছে গা। ঘরে কোনো কিচ্ছু নাই। আমি অসহায় হইয়া গেছি। রাজনীতির সন্ত্রাস আমারে শ্যাষ কইরা দিছে।'

মাসুদুরের বাড়ির ৪টি রুমে টিভি, ফ্রিজ, খাটসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে আছে। বাড়ির বাইরে আগুনে পোড়া আসবাবপত্র ও টিন দেখা যায়।

ভুলতায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমানের বাড়িতে হামলা হয়। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

শনিবার রাতে মাসুদুর ছাড়াও ছাত্রদল ও যুবদলের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মীর বাড়িতেও হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র, রাম দা, লাঠিসোটা হাতে নিয়ে তারা হামলা করে এবং ঘরের বাইরে-ভেতরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

মাসুদের বড়ভাই ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মাসুম রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছোট ভাই বিএনপির রাজনীতি করে। শনিবার রাতে হেরা একটা মিছিল করছিল। মিছিল-টিছিল দিয়া ভাইয়ে তো গেছে গা। হেরপর আওয়ামী লীগের লোকজন আইসা বাড়িতে এসব করে।'

বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান চালান মাসুদের আরেক ভাই শামীম। স্বামীর পাশাপাশি ওই দোকানে নিজেও বসেন রাবেয়া। ওই দোকানও ভাঙচুর করে মালামাল সব লুট করা হয়েছে বলে জানান তারা।

রাবেয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পিস্তল, রাম দা হাতে দলে দলে লোকজন ঢুইকাই মারধর আর গালাগালি শুরু করে। আমারে গলায় চাপ দিয়া ধইরা গালাগালি করে। একজন মাথায় পিস্তল ঠেকাইয়া বলে, কথা কইলে মাইরালামু। হেরপর ঘরে থাকা এক লাখ টাকা, গয়না-গাটি যা আছিল সব নিছে গা। ঘরে কিচ্ছু নাই। সব শ্যাষ কইরালাইছে।'

পাশে চেয়ারে বসা কিশোর ছেলেকে দেখিয়ে রাবেয়া বলেন, 'ছেলেরে দুই হাতে তুইলা নিয়া কয়, ওরে জবাই কইরালামু। পোলাডারে ছাইড়া দেওয়ার লাইগা হাতে-পায়ে ধইরাও কাম হয় নাই। আমার সন্তানডারে মাইরা রাখে নাই। পনের বছরের পোলাডারে কোপাইছে, দশ বছরের মাইয়ারেও মারছে। কাউরে ছাড়ে নাই।'

আহাজারি করছেন মাসুদুরের ভাবি রাবেয়া বেগম। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

রাবেয়া বলেন, 'আমি কোনো কাইজ্জায় যাই নাই। আমার স্বামীও রাজনীতি করে না। ছোট দেবর রাজনীতি করে। আমরা এইসবের লগে কিছু না। আমি আর আমার স্বামী আমি দোকানদারি করি। দোকানের যা আছে সব নিছেগা, কিচ্ছু নাই।'

ঘরে লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। আগুনে পুড়ে গেছে শিক্ষাগত ও জন্মনিবন্ধনের সনদপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। 

পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদল নেতা মাসুদুর রহমানের ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী রেহানা রহমানের বই-খাতা।

হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী শান্তা ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বড় বড় রাম দা নিয়া একেকজন ঢুকছে। আমরা দেখছি কিন্তু আইসা কাউকে ঠেকানোর সাহস হয় নাই। অনেক মানুষ ছিল তারা। বাড়ির চারদিকে মানুষজনে ঘেরাও ছিল।'

'একভাই রাজনীতি করে অন্যগুলা তো আর করে না। বাচ্চাগুলারেও পিটাইছে। বাচ্চারা তো আর রাজনীতি করে না। এইটা কোনো রাজনীতি না। দোকান ভাঙার সময়ও "জয় বাংলা" শ্লোগান দিছে। আমরাও আতঙ্কে ছিলাম সবাই,' যোগ করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে মাসুদুর রহমান মোবাইল ফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, হামলার ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে তারা বৃদ্ধ বাবা শাহাবুদ্দিন ও মা উম্মে হানি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

হামলার পর থেকে ভয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার বাড়ির সামনে রোববার সকাল থেকে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা হাতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মহড়া দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

হামলার ঘটনায় মামলা করবেন কি না, জানতে চাইলে ছাত্রদলের এই নেতা বলেন, 'পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে হামলাকারীরা প্রথমে বাড়িতে ঢোকে। সবকিছুই তো পুলিশ জানে। চাইলে পুলিশ তখনই ব্যবস্থা নিতে পারত। মামলা করলে বাড়িতে যা কিছু আছে, তাও আগুন দিয়া জ্বালাইয়া দিবো।'

তবে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কেউ জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া৷ তিনি বলেন, 'হামলার কোনো ঘটনা শুনিনি৷ এমন কোনো ঘটনায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কেউ জড়িত না৷'

পুলিশের সামনে হামলা হয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার ('গ' সার্কেল) আবীর হোসেন তা অস্বীকার করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, শনিবার রাজধানীতে তাবিথ আউয়ালসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাত ৯টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বলাইখাঁ থেকে ভুলতা পর্যন্ত একটি মশাল মিছিল করে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। 

মিছিলের খবর পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে পাল্টা মিছিল করে, তাৎক্ষণিক সমাবেশও করে। এ সমাবেশের পরই হামলার ঘটনা ঘটে।

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on interim government

Interim govt must not be allowed to fail: Tarique addresses BNP rally

Thousands join BNP rally from Nayapaltan to Manik Mia Avenue

5h ago