আইএমএফের ঋণের কিস্তি পেয়েও স্থিতিশীল নয় রিজার্ভ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার দেয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে মোট ৩৩০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে।  

বর্ধিত ঋণ-সুবিধা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল-সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় এই ঋণের অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এর উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চলমান অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় সহায়তা।

যদিও আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছে, মুদ্রা বাজারে নিয়মিত ডলার না ছেড়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাড়তে। 

কিন্তু এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করছে না বলে জানিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। 

গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা বাজারে ৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছেড়েছে, যা এ যাবতকালের রেকর্ড। 

আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ ফেব্রুয়ারি ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। কিন্তু মুদ্রা বাজারে ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় রিজার্ভ কমে গতকাল ৩২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। 

গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। 

বেশ কয়েকমাস ধরে দেশের মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার মধ্যে আইএমএফের এ ঋণ সহায়তা এল। অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে উচ্চতর আমদানি বিল, প্রত্যাশার চেয়ে কম রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রাপ্তি। 

আইএমএফের নথি অনুযায়ী, স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পুনর্গঠন তাদের কাছে জরুরি ও প্রাধান্যের বিষয়। 

আইএমএফ বলেছে, 'মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে আরও নমনীয়তা চর্চা করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করা। ইসিএফ ও ইএফএফ কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগ রিজার্ভকে স্থিতিশীল করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।'  

'ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ব্যবহার শুধু অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত', আইএমএফ জানায়। 

চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে সরকারকে আইএমএফের শর্ত মেনে চলতে হবে।

আইএমএফের পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জুনে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকতে পারবে না। 

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ গণনার সময় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল এবং অন্যান্য কিছু স্কিমের অধীনে তহবিল বিবেচনা করে না, যা আইএমএফের রিজার্ভ মানদণ্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভে আরও অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার যোগ করতে হবে। 

অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জুনে অন্তত ৩২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রাখতে হবে।

মনসুর বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। যদি রিজার্ভের পরিমাণ আইএমএফের নির্ধারিত মানদণ্ডের নিচে নেমে যায়, তাহলে সংস্থাটি বাংলাদেশে তাদের এই কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে পারে এবং ঋণের পরবর্তী কিস্তি বিতরণ স্থগিত রাখতে পারে'। 

আইএমএফ ৪২ মাসে একাধিক কিস্তিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করবে।

আইএমএফের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা আহসান মনসুর বলেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যদি প্রত্যাশিত মাত্রায় না বাড়ে, তাহলে সরকারকে আরও কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের মার্কিন ডলার আয়ের বৃহত্তম দুই উৎস রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিঘ্নিত হওয়ায় হওয়ায় চলতি বছরে এই দুই খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-জানুয়ারিতে রপ্তানি ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়ে ৩২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।

মনসুর জানান, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের আর্থিক হিসাব এখনো নেতিবাচক হওয়ায় ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহারসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কিছু নীতিগত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ঋণ পরিশোধ ও আমদানি বিল পরিশোধের পরিমাণ বিবেচনায় শুধু আইএমএফের তহবিল ব্যবহার করে রিজার্ভকে আগের অবস্থায় আনা সম্ভব হবে না।

জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আইএমএফ ও স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়েরই আর্থিক খাতে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা উচিত।'

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে অবৈধ হুন্ডি চক্রকে ঠেকাতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

২০২২ সালে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি চাকরির সন্ধানে বিদেশে যাওয়া সত্ত্বেও রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রত্যাশার চেয়ে এখনও কম। গত বছর ১১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বিদেশে চাকরির জন্য দেশ ছাড়েন।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর বলেন, 'সর্বোপরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যবসায়ীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রপ্তানি আয় ফেরত পাঠাতে বলা।' 

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্প্রতি চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে এলেও অধিকাংশ ব্যাংক এখনো ডলার ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।'

'কিছু ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না', যোগ করেন তিনি।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

5h ago