‘বিরুদ্ধতার’ স্রোতে কীর্তনখোলার তীরে নৌকা ভিড়ল যেভাবে

সব বিরুদ্ধতার স্রোত পেরিয়ে নিজের পরিচ্ছন্ন ইমেজকে সঙ্গী করে নির্বিঘ্নেই কীর্তনখোলার তীরে দুলে ওঠা আওয়ামী লীগের নৌকা ভেড়ালেন ‘নবীন’ আবুল খায়ের আবদুল্লাহ।
সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন। ছবি: পলাশ খান/স্টার

বরিশালের রাজনীতি ও ভোটারদের কাছে তিনি ছিলেন নতুন মুখ। তার প্রার্থী হওয়াটাই ছিল এক রকমের চমক। মনোনয়ন নিয়ে সম্পর্কে ভাতিজা ও বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে তার বিভেদ দানা বেঁধেছিল। এই বিভেদ নিরসনে ভাই হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে কেন্দ্র ৯ সদস্যের একটি কমিটি করে দিলেও ভোটের আগে তাতে আস্থা রাখার মতো দৃশ্যমান কোনো পরিস্থিতি দেখা যায়নি। ফলে প্রচারের শুরু থেকেই নিজ দল আওয়ামী লীগের একটি অংশের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে।

এর বিপরীতে বরিশাল অঞ্চলে প্রভাবশালী চরমোনাই পীরের ছেলে মুফতী ফয়জুল করীম যখন এবার মেয়র প্রার্থী হন, তখন বিএনপিবিহীন নির্বাচনও জমে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এই সম্ভাবনার পালে হাওয়া লেগেছিল গত মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতে চমক সৃষ্টির পর। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের যে ভোটের হার, তাতে বরিশালেও হাতপাখার ঝাপটায় নৌকাডুবির আশঙ্কা করেছিলেন কেউ কেউ। আবার সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা গোপনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন—এমন গুঞ্জনও ডালপালা মেলেছিল বরিশালে।

কিন্তু সব বিরুদ্ধতার স্রোত পেরিয়ে নিজের পরিচ্ছন্ন ইমেজকে সঙ্গী করে নির্বিঘ্নেই কীর্তনখোলার তীরে দুলে ওঠা আওয়ামী লীগের নৌকা ভেড়ালেন 'নবীন' আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। অনেকের কাছে যিনি পরিচিত খোকন সেরনিয়াবাত নামে।

গতকাল সোমবার হাতপাখার মেয়রপ্রার্থী ফয়জুল করীমের ওপর হামলা, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ ও এর রেশ ধরে তার সমর্থকদের বিক্ষোভের মধ্যে অন্য কোনো গোলযোগ ছাড়াই ইভিএমে ১২৬ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। রাত ৯টার পর জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের ফয়জুল করীম হাতপাখা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮টি। অর্থাৎ ২ জনের ভোটের ব্যবধান ৫৩ হাজারের বেশি।

বরিশাল সিটির ভোটার, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর যে একচ্ছত্র প্রভাব আছে, তার অবসানের সূচনা হতে পারে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর এই জয়। তারা বলছেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ ২০১৮ সালে বরিশাল সিটির মেয়র হওয়ার পর স্থানীয় রাজনীতিতে তার আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ হয়। আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মীর পাশাপাশি বাবা-ছেলের এই আধিপত্যের খড়গ থেকে থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল সাধারণ ভোটার থেকে বিরোধী রজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও। যার প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের ফলাফলে।

এর পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে হাতপাখা নিয়ে কারও কারও 'উচ্চাশা' থাকলেও এ নিয়ে তাদের বক্তব্য, বরিশালে ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারীদের তুলনায় প্রগতিশীল চেতনার মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই 'বিশেষ পরিস্থিতিতে' শুরুতে একটা 'হাইপ' উঠলেও ভোটের মাঠে তার প্রভাব পড়েনি।

ভোটের পরদিন আজ মঙ্গলবার সকালে বরিশাল নগরীর নাজির মহল্লা কাঠের পুল এলাকায় কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা তরুণ চন্দের সঙ্গে। তার বক্তব্য, 'দীর্ঘদিন বরিশালের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এককভাবে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নেতৃত্বে ছিলেন। ন্যাচারালি বড় একটা দলে একই নেতৃত্বের পরিবর্তনের একটা আশা করেছিলেন কর্মীরাও। আবুল খায়ের আবদুল্লাহ এবার হঠাৎ করেই নমিনেশন পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাদিকের ৫ বছরের যে রেজিম, তার থেকে মুক্তির একটা আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠেছিল। এখানে পাওয়া না পাওয়ার বিষয় ছিল, বিপক্ষের লোকেরা ছিল, বিক্ষুব্ধরা ছিল। দলের যেসব ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন হয়নি তারাও আশার আলো দেখেছিল। তাই খায়েরকে নির্বাচিত করার সুযোগ তারা ছাড়েনি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি তো আওয়ামী রাজনীতির বর্তমান ধারার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র, আদর্শ, গণতন্ত্র, শৃঙ্খলা—এগুলো ধারণ করে আছি। এখন যেটা হয়েছে, যে যখন ক্ষমতায় থাকে তার একটা প্রভাববলয় তৈরি হয়, কিছু সুবিধাবাদী লোকেরা সুযোগ-সুবিধা নেয়। কিন্তু ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন হয় না। আমাদের বরিশালেও সেটা হয়েছে।'

আর ব্যক্তি আবুল খায়ের আবদুল্লাহর প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতার মূল্যায়ন হলো, 'খোকনের (আবুল খায়ের আবদুল্লাহর) একটা ক্লিন ইমেজ আছে। বরিশালে তাকে কেউ দেখেনি। যে আম আমরা খাই নাই, তার বর্ণনা যদি এমন হয় যে এটি খুব সুমিষ্ট আম, নতুন প্রজাতির আম, তার প্রতি একটা মোহ থাকে। এই মোহ থেকে আওয়ামী লীগের বাইরের লোকেরাও খায়েরকে ভোট দিয়েছে। সবার মনে হয়েছে সে হয়তো তার বাবা রব সেরনিয়াবাতের মতোই হবে।

'বরিশালে এত ভোট কোনোদিন আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী পায়নি। আওয়ামী লীগের বাইরেও মৌলবাদ বিরোধী, প্রগতিশীল চিন্তার বিএনপির সাধারণ সমর্থকরাও তাদের ভোট দিয়েছে।'

নির্বাচনে হাতপাখার প্রার্থীকে নিয়ে আলোচনার বিষয়ে তরুণ চন্দের ভাষ্য, 'এই শহরে হাতপাখার প্র্যাকটিক্যাল ভোট আছে ১৫ হাজার। সেই ৯১ সাল থেকে ১০টা ইলেকশনে ইনভলভ থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বরিশালে ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারী মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না। নেতৃত্বস্থানীয় মানুষগুলো মারা গেলেও এখানে প্রগতিশীল চেতনার মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই তারা সুবিধা করতে পারেনি।'

এ ছাড়া তরুণ চন্দের ধারণা বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ভোটও পেয়েছেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ভোটগুলোও পেয়েছেন খায়ের। তাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন স্বার্থেই নৌকায় ভোট দিয়েছে। কারণ তারা দল থেকে বহিষ্কার হয়েছে। তারা ভেবেছে নির্বাচিত হতে পারলে হয়তো খায়ের আবদুল্লাহর কাছে একটা আশ্রয় পাওয়া যাবে। সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে।'

এ ছাড়া বিএনপির ভোট তালপাখায় না যাওয়ার কারণ সম্পর্কিত একটি ঘটনা উল্লেখ করে তরুণ চন্দ বলেন, 'বরিশালে বিএনপির শীর্ষ নেতা সরোয়ার (মজিবর রহমান সরোয়ার) সাহেবকে ইউনিয়ন নির্বাচনে এই তালপাখার প্রার্থী অ্যাসল্ট করছিলেন, তার দাঁত ভেঙে ফেলছিলেন। পরে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের জায়গা থেকেই হয়তো সারোয়ার সাহেব সংবাদ সম্মেলন করে বলছিলেন, তোমরা তালপাখাকে ভোট দেবে না।'

আওয়ামী লীগ জোর দিয়েছিল গণসংযোগে, ইসলামী আন্দোলন প্রচারণায়

এবারের সিটি নির্বাচনে বরিশালে হাতপাখার প্রচারণার বিষয়টি ছিল চোখে পড়ার মতো। শহরের বাসিন্দাদের ভাষ্য, জাঁকজমকপূর্ণ এই প্রচারণার কাজে জেলার বাইরে থেকে আসা হাজারো সমর্থক অংশ নেয়। কিন্তু এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ বেছে নেয় গণসংযোগের পথ। পায়ে হেঁটে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া, উঠান বৈঠকের মতো নানা কর্মসূচি ছিল তাদের।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচনের ফলাফলে এই গণসংযোগের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বরিশালে সবাই একটা পরিবর্তন চাচ্ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনে আসেনি, তাদের ভেতরেও এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাটা ছিল। আর সব মহলের কাছে যেহেতু আবুল খায়ের আবদুল্লাহর একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাই তারা তাকে নির্বাচিত করতে ভুল করেনি।'  

এর বাইরে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরেও নির্বাচনী প্রচারে তার ভাই-ভাতিজাসহ জেলা-মহানগর আওয়ামী লীগের অসহযোগিতার বিষয়টিও সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি বলে মনে করেন রফিকুল আলম।

তিনি মনে করেন, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বরিশালের রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের একটা সহাবস্থান তৈরি হবে। তাতে এই শহরে উন্নয়নের ধারাটাও বেগবান হবে। পায়ে পায়ে ইতিহাস জড়ানো এই শহরে এতদিন ধরে যা ছিল অধরা।

Comments

The Daily Star  | English

US sanction on Aziz not under visa policy: foreign minister

Bangladesh embassy in Washington was informed about the sanction, he says

1h ago