এক টাকায় অভিনয়ের ‘বিনিময়ে’ ১০ কাঠার প্লট বিতর্ক

ঢাকা শহর তো বটেই, এর আশেপাশেও একটি প্লট কিংবা ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া বিরাট সংখ্যক মধ্যবিত্ত বাংলাদেশির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। টেলিভিশনে প্রচারিত একটি আবাসন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন ছিল—'স্বপ্ন হলো সত্যি'।

নিজের কষ্টার্জিত টাকায় একজন মধ্যবিত্তের পক্ষে ঢাকা শহর কিংবা এর আশেপাশের এলাকায় একটি ফ্ল্যাট বা প্লটের মালিক হওয়া বেশ কঠিন। হয় তাকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়, না হয় গ্রাম কিংবা জেলা-উপজেলা শহরের জায়গা-জমি বিক্রি করতে হয়। না হয় ঘুষ খেতে হয়। অর্থাৎ অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করতে হয়।

এরকম বাস্তবতায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তুলনামূলক কম দামে প্লট বিক্রি করে থাকে। যদিও সেই প্লট কারা পান, কোন তরিকায় পান—সেটি বিরাট তর্কের বিষয়।

রাজউকের এই প্লট পাওয়ার একটি বিশেষ ক্যাটাগরি আছে। অর্থাৎ সরকার চাইলে বিশেষ বিবেচনায় রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিককে ১০ কোটি টাকা দামের প্লটও নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দিতে পারে—যার অনেক উদাহরণ আছে।

সম্প্রতি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ৭১ টেলিভিশনের সাবেক উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা পূর্বাচলে রাজউকের ৫ কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন, বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী যার দাম কয়েক কোটি টাকা।

মিথিলা ফারজানার আগে নিশ্চয়ই সরকারের এ রকম বিশেষ বিবেচনায় আরও অনেকেই রাজউকের প্লট পেয়েছেন। কিন্তু সবার প্লট পাওয়ার খবর গণমাধ্যমে আসেনি। কারণ, যারা প্লট পেয়েছেন, তাদের সবার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ নেই। তারা ওই অর্থে সেলিব্রিটি নন। কিংবা সেলিব্রিটি হলেও তারা আলোচিত নন।

অথবা মিথিলা ফারজানা ৭১ টিভির সাংবাদিক ছিলেন বলেই তার প্লট পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ আলোচনা হয়েছে। তিনি অন্য কোনো গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের কর্মী হলে এবং আলোচিত না হলে হয়তো তার প্লট পাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার বিষয়ই হতো না। অথবা সেরকম না হলে তিনি হয়তো প্লটও পেতেন না।

প্লট পাওয়ার পরবর্তী খবর হচ্ছে, মিথিলা ফারজানা এখন আর ৭১ টিভির সঙ্গে যুক্ত নেই। তাকে দুই বছরের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের পরিচালক/কাউন্সিলর পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এবার রাজউকের প্লট পেয়ে আলোচনায় এসেছেন চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ—যিনি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক 'মুজিব' সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি এই ছবিতে অভিনয়ের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নেননি। তবে প্রতীকী হিসেবে এক টাকা সম্মানী নিয়েছেন। যে কারণে আরিফিন শুভর এক টাকা সম্মানীতে অভিনয় করার বিষয়টিও গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর মতো একজন পাহাড়সমান ব্যক্তিত্বের চরিত্রে অভিনয় করার মতো যোগ্যতা শুভর আছে কি নেই; তিনি সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর যে কণ্ঠস্বর—তার কতটুকু আরিফিন শুভর কণ্ঠে প্রতিফলিত হয়েছে; অথবা এই চরিত্রে অভিনয় করার মতো দেশে আর কোনো অভিনেতা ছিলেন কি না—সেসব অন্য তর্ক।

কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই এবং শুভও হয়তো এটি স্বীকার করবেন যে, তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা। অতএব এটিও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন বলেই কোনো পারিশ্রমিক নেননি। তার এই পারিশ্রমিক না নেওয়ার বিষয়টিও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল।

কিন্তু এখন তার এই পারিশ্রমিক না নেওয়া কিংবা এক টাকার বিনিময়ে অভিনয় করার ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট পাওয়ার সংবাদ প্রকাশের পরে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সংরক্ষিত কোটায় রাজউকের ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন আরিফিন শুভ। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর রাজউকের বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। পরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিনেতা আরিফিন শুভর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিয়ে বরাদ্দের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। (প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০২৪)

এই খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বিষয়টিকে 'এক টাকায় অভিনয় করার বিনিময়ে ১০ কাঠার প্লট' বলে মন্তব্য করছেন। অনেকেই তির্যক মন্তব্য করেছেন। অনেকে শুভকে 'দূরদর্শী' বা 'পাকা খেলোয়াড়' বলেও মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ তাদের সমালোচনার মূল জায়গাটি হলো, আরিফিন শুভ বিনা পয়সায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করলেও তার আসল উদ্দেশ্য ছিল এর বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে বড় কিছু আদায় করা। অর্থাৎ এক টাকায় অভিনয় করার বিষয়টি ছিল 'স্ট্যান্টবাজি'। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিও শুভর এই প্লট পাওয়ার বিষয়ে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ তাদের মন্তব্য বা স্ট্যাটাস পরে সরিয়েও নিয়েছেন।

বাস্তবতা হলো, আরিফিন শুভই চলচ্চিত্র জগতের প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে রাজউকের প্লট পেয়েছেন। কিন্তু অতীতে কারো প্লট পাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হয়নি বা গণমাধ্যমে সংবাদও হয়নি। কিন্তু শুভর বিষয়টি রাষ্ট্র হয়ে গেলো কেন?

কারণ কি এই যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে বিনা পয়সায় অভিনয় করেছেন? তিনি যদি পারিশ্রমিক নিয়ে অভিনয় করতেন এবং এই প্লট পেতেন, তাহলে কি সমালোচনা হতো? অথবা তিনি যদি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় না করতেন এবং প্লট পেতেন, তাহলে কি এটি নিয়ে সংবাদ হতো? অথবা এরকম একটি সিনেমায় অভিনয় না করলে তিনি কি বিনামূল্যে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট পেতেন?

চলচ্চিত্র ও বিনোদন দুনিয়ায় অসংখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্লট বা ফ্ল্যাট নেই। অনেকে আর্থিক কষ্টেও আছেন। রাষ্ট্র কি তাদের সবার পাশে দাঁড়ায় বা সবাইকে প্লট দেয়? সবার পাশে দাঁড়ানো বা সবাইকে প্লট দেওয়া কি বাস্তবসম্মত বা সম্ভব?

তার মানে সরকার কাকে বিশেষ বিবেচনায় প্লট বা ফ্ল্যাট দেবে, সেই এখতিয়ার তার আছে। বিষয়টি যেহেতু বিশেষ বিবেচনা, অতএব তাকে বিশেষ হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে বিনা পয়সায় অভিনয় করে আরিফিন শুভ যেহেতু 'বিশেষ' হয়েছেন, অতএব সেই বিশেষ বিবেচনায় তার রাজউকের প্লট পাওয়া অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। বরং তিনি যে বিনা পয়সায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করলেন, তার বিনিময়ে রাষ্ট্র যে তাকে কোনো না কোনো সুবিধা দেবে এটিই স্বাভাবিক।

শুভ নিজে সরকারের কাছ থেকে বড় কোনো সুবিধা নেওয়ার জন্যই বিনা পয়সায় অভিনয় করেছিলেন, নাকি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে পারিশ্রমিক নেননি, সেটি তিনিই ভালো জানেন। তবে আমরা বিশ্বাস করি, তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকেই পারিশ্রমিক নেননি। অতএব সরকার যদি তাকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিংবা ভালোবাসার স্মারক হিসেবে ১০ কাঠার প্লট দিয়ে থাকে, সেটি দোষের কিছু নয়।

আলোচনাটি বরং অন্য জায়গায়। সেটি হলো, রাজউকের প্লট আসলে কারা পান, কোন প্রক্রিয়ায় পান? যেসব প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়, সেই প্রক্রিয়া কি মানা হয়? দলীয় বিবেচনা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাই কি এখানে মূল ভূমিকা পালন করে না? সাংবাদিকদেরও যে এই প্লট দেওয়া হয় বলে শোনা যায়, সেখানে কি স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়? দলীয় বিবেচনার বাইরে কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মী কি আজ পর্যন্ত রাজউকের প্লট পেয়েছেন? সরকারি কর্মকর্তারা কোন যোগ্যতায় এবং কীসের বিনিময়ে এখানে প্লট পান? সেখানে কি স্বচ্ছতা বজায় থাকে?

রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা সাংবাদিকদের বলেছেন, 'সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংরক্ষিত কোটায় যথাযথ মাধ্যমে আবেদন এলে রাজউকের বোর্ডসভায় তা আলোচনা হয়। সেখানে বোর্ডের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে তা অনুমোদন হয়। তিনি বলেন, প্লট বরাদ্দের জন্য অনেক আবেদনই আসে। সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত এলে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প থেকে প্লট দেওয়া হয়। কারণ, পূর্বাচল ছাড়া এখন প্লট দেওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই।'

তবে আরিফিন শুভর এই প্লট পাওয়াটা যে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে হয়নি, বরং এখানে সরকারের বিশেষ আনুকূল্য রয়েছে—তাতে সন্দেহ নেই।

প্রসঙ্গত, রাজউকের বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, সংরক্ষিত কোটায় প্লট দেওয়া হয় ১৩-এ ধারা মতে। এ ধারায় বলা আছে, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা; যারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রেখেছেন, তাদের প্লট দেওয়া যায়।

অতএব এই কোটায় যাদেরকে প্লট দেওয়া হয়েছে, তারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে কী অবদান রেখেছেন? রাজউক কি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে যে কাকে ঠিক কোন অবদানের জন্য সংরক্ষিত কোটায় প্লট দেওয়া হয়েছে? নাকি যাদেরকে প্লট দেওয়া নিয়ে সমালোচনা বা আলোচনা হচ্ছে তাদেরকে সরকারি নির্দেশে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে? রাষ্ট্র কি চাইলেই যে কাউকে বিশেষ বরাদ্দ দিতে পারে এবং দিলেও সেটি কি আনচ্যালেঞ্জড? কোনো নাগরিক কি রাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে বা প্রশ্ন করতে পারেন?

প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব আশাপ্রদ হবে না। অতএব শুধু একজন অভিনেতা কিংবা একজন সাংবাদিকের প্লট পাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তির্যক মন্তব্য করাই যায়, তাতে রাজউকের প্লট নিয়ে যেসব প্রশ্ন জনমনে আছে, তার সদুত্তর পাওয়া যাবে না। বরং সরকারের প্রতিটি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ও সুশাসনের যে ভয়াবহ ঘাটতি এবং যে ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে, সেখানেই নজর দেওয়া দরকার। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েই বরং কথা বলা দরকার।

যাদের প্লট, ফ্ল্যাট বা জমি আছে; অর্থাৎ যারা সচ্ছল, তাদেরকে বিশেষ বিবেচনায় কিংবা সংরক্ষিত কোটায় রাজধানী বা এর আশেপাশে সরকারি প্লট দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। কেননা সম্পদশালী ব্যক্তির সম্পদ বাড়ানোর চেয়ে যার সম্পদ নেই তার দিকে রাষ্ট্রের নজর দেওয়া দরকার।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Hilsa fish production in Bangladesh

Hilsa: From full nets to lighter hauls

This year, fishermen have been returning with lesser catches and bigger losses.

14h ago