এক দল থেকে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা: যা ছিল ‘কার্যত’, এখন তা ‘আইনসিদ্ধ’
পঞ্চমবারের মতো ও টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীর এটিই দীর্ঘতম মেয়াদ। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে বাংলাদেশের সবকিছুই তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় তার যোগ্যতা সম্পর্কে এবং একইসঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেই সম্পর্কে।
নীতি গ্রহণ থেকে শুরু করে পরিকল্পনা, প্রকল্প ও এর বাস্তবায়ন, ব্যষ্টিক থেকে সামষ্টিক, ফ্লাইওভার তৈরি থেকে কাঁচামরিচ সংরক্ষণ, বৃহত্তর পরিসর থেকে একেবারে খুঁটিনাটি—আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে না চাইলে সবকিছুতেই তার প্রত্যক্ষ সম্মতি থাকতে হবে। প্রত্যেকটি মেগা প্রকল্প এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য ধন্যবাদ তারই প্রাপ্য।
জনশ্রুতি আছে, ফায়ার সার্ভিসের এক টিম লিডার ঢাকায় একটি বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর সময় একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছিলেন, তিনি ও তার দল প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দিকনির্দেশনায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে এর থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফুরন্ত কর্মক্ষমতা, অসংখ্য বিষয়ে আগ্রহ এবং তার সর্বময় কর্তৃত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকদের মতে, তিনি এর যোগ্য, কারণ তার আগে কেউ বাংলাদেশে এত বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন করতে সক্ষম হননি। তাদের এই দাবি ভিত্তিহীন নয়।
গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন নির্বাচনের ওপরও শেখ হাসিনার কতটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তার আরেকটি উদাহরণ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন—বিরোধী দল বর্জন করায় যেটা তার জন্য আরও সহজ হয়ে যায়। বেশিরভাগ বিষয়ে আগে থেকেই রফা হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনের দিন তেমন কোনো বাধা-বিঘ্নের ঘটনা ঘটেনি। বিএনপি প্রমাণ করেছে যে, তারা শেখ হাসিনার কৌশলী চিন্তা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম না এবং নির্বাচন বর্জন করায় তাদেরকে যে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে চড়া মূল্য চুকাতে হবে, সে বিষয়েও খুব সামান্যই ভেবেছে।
প্রধানমন্ত্রীর জাতীয়তাবাদী কার্ডের (ন্যাশনালিসটিক কার্ড) ব্যবহার ছিল সাহসিকতাপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি দক্ষতার সঙ্গে বড় শক্তিগুলো মোকাবিলা করেছেন। তার সমর্থনে চীন ও ভারতকে এক কাতারে নিয়ে আসা এমন একটি বিষয়, যা থেকে অনেক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতা শিক্ষা নিতে পারেন।
সবকিছুই যে শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে আছে, তা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে। আওয়ামী লীগ জিতেছে ২২২টি আসনে। আর ৬২টি আসনে জিতেছে 'বিদ্রোহীরা', যাদের মধ্যে ৫৮ জন আজীবন আওয়ামী লীগ করেছে এবং তাদের এই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে দলেরও সম্মতি ছিল।
আওয়ামী লীগের আশীর্বাদে ১১টি আসনে জিতেছে জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া, সার্বিক পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রতীক বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতীক 'নৌকা' নিয়ে নির্বাচন করে দুটি আসনে জিতেছে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীরা।
অর্থাৎ, মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ঘোষিত ২৯৮টির ফলাফলে ২৯৩ আসনে আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের 'অনুমোদিত' বা 'আশীর্বাদপুষ্ট' প্রার্থীরা জিতেছেন।
আনুপাতিক হারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আরও ৫০টি আসনের কথা বিবেচনা করলে, এগুলোর বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা খুব সহজেই আরও অন্তত ৪৫টি আসনে নিজের লোক পাবেন। কাজেই সর্বমোট ৩৫০ আসনের সংসদের ৩৩৮টি আসনই তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
সেক্ষেত্রে এটাকে কি কোনোদিক দিয়েই একদলীয় শাসন ছাড়া অন্যকিছু হিসেবে অভিহিত করা যাবে? এই মাত্রাতিরিক্ত সাফল্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নিজস্ব দুর্বলতাও রয়েছে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩টি কোনো আসন পায়নি। এই দলগুলোর বেশিরভাগ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এর থেকে প্রমাণ হয় যে তাদের কোনো জনসমর্থন ছিল না। তাদেরকে নির্বাচনে আনা হয়েছে শুধুমাত্র এটা দেখানোর জন্য যে, অনেকগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
নির্বাচনে একমাত্র যে দলটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত, সেই বিএনপি নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার আগেই পুলিশি অ্যাকশনে পর্যুদস্ত হয়ে যায়। একের পর এক মামলা, নেতাদের গ্রেপ্তার, দ্রুত বিচারে সাজা ও ভয়ভীতিতে দলটির এই অবস্থা হয়ে যায়।
বিএনপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাদের ১৩ হাজার ৪২৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়েরকৃত ৪৯৯টি মামলার এফআইআরে দলটির ৫২ হাজার ৩৪২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
এই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে একটি ঘটনাতেই। সেটি হলো—রাজনৈতিক অঙ্গনে সবার শ্রদ্ধাভাজন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ অক্টোবর থেকে এখনো কারাগারে আছেন এবং বারবার আবেদন করার পরও তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না।
তবে নির্বাচন বর্জনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপির প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
এবারের নির্বাচনের ফলাফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শেখ হাসিনার সুপ্রিম লিডার হয়ে ওঠা। অনেক বছর ধরেই তিনি এই ভূমিকায় আছেন। কিন্তু এই নির্বাচনে তার এই অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। যা আগে ছিল 'কার্যত', তা এখন 'আইনসিদ্ধ'।
ভারতে নির্বাসন থেকে ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তিনি তার ক্ষমতা সুসংহত করছেন। প্রথমে দলের ভেতরে এবং তারপর সরকারে। আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনীতিকরণ ও তাদের বড় আকারে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এবং সবশেষে সারাদেশে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিরুদ্ধমতকে সম্পূর্ণভাবে দমন করে তিনি হয়ে উঠেছেন সুপ্রিম লিডার।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল এটাই যে, সংসদে দু-তিনজন ছাড়া এমন কোনো সদস্য নেই যিনি কোনো না কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ নন। দীর্ঘদিন ধরেই যে সংসদ তার নীতি বাস্তবায়নের রাবার স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছুই নয়, সেই সংসদে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না এবং তার ছাড়া আর কারও কণ্ঠ সেখানে প্রতিধ্বনিত হবে না।
গত সংসদে বিএনপির সাত জন সংসদ সদস্য অন্তত ছিলেন। তারা সুযোগ পেলেই সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতেন। তবে এবার সেইটুকু বিরোধিতাও আর থাকবে না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই একই সুরে গাইবে।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এবারের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয় এতটাই নিরঙ্কুশ যে এখন তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিরোধী দলীয় নেতা কে হবেন। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পরে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী সবচেয়ে বড় গ্রুপটি তথাকথিত 'স্বতন্ত্র'দের, যারা সবাই আওয়ামী লীগে ফিরতে চান। হয়তো শেখ হাসিনা তাদেরকে 'বিরোধী দল' গঠনে উৎসাহিত করতে পারেন এবং নেপথ্যে থেকে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। এভাবেই তিনি আইনসিদ্ধভাবে সংসদ নেতা ও কার্যত বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। তার এই অবিশ্বাস্য অর্জনে রয়েছে বিপুল বিপদের ঝুঁকি। সংসদ সম্পূর্ণভাবে তার ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ছে এবং গণতন্ত্রকে পাঠানো হলো ভেন্টিলেশনে, যেখানে অক্সিজেনের নিয়ন্ত্রণ থাকল একজনের হাতে।
নিজেদের পিঠ চাপড়ানো ও অভিনন্দন জানানোর বিষয়গুলোকে এক দিকে সরিয়ে রাখলে বলা যায়, নির্বাচনে কম সংখ্যক ভোটার উপস্থিতির মাঝে বিজয়ী দলের জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। ধরা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের ভোট-ব্যাংক মোট ভোটারের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মতো। সেই হিসাবে ৪১ দশমিক আট শতাংশ ভোটার উপস্থিতি (নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী) থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের ভোটাররাই কেবল ভোট দিয়েছেন এবং অনুমিত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিরপেক্ষ ভোটার ও বিএনপির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোটার (আগের নির্বাচন থেকে পাওয়া তথ্যমতে) এই নির্বাচন থেকে দূরে থেকেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৯ শতাংশ ভোটার এই নির্বাচনকে এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে বর্তমান সরকার জয়ী হয়েছে, এমন অত্যুৎসাহী দাবিগুলো আরও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং এর থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, শেখ হাসিনা এখন এমন একটি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন যে দেশে যা কিছুই ঘটবে, তার জন্য এককভাবে তিনিই দায়ী হবেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে, তার সবটাই শেখ হাসিনার দোরগোড়ায় এসে হাজির হবে এবং সংশ্লিষ্ট সব দায়ও তার দিকেই আসবে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থপাচার, জ্বালানিতে অসহনীয় ভর্তুকি ও বিশ্ব বাজারের অস্থিরতায় আমাদের রপ্তানি কমে যাওয়া—এসব সমস্যা আগামী মাসগুলোতে আমাদেরকে প্রভাবিত করবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেও দিয়েছেন যে, আইএমএফের সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা সংস্থাটির শর্ত মোতাবেক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখতে পারিনি। হতে পারে, এটাই শর্ত লঙ্ঘনের একমাত্র বা শেষ ঘটনা নয়, সামনে আরও উদাহরণ তৈরি হবে।
গত দশকে, বিশেষত গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি লাগামহীনভাবে বেড়েছে এবং এ বিষয়টিকে অস্বীকার করা উটপাখির মতো মাটিতে মাথা গুঁজে থাকা ছাড়া কিছুই নয়। ক্রমাগত বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার 'রক্ত' শুষে নিচ্ছে এবং এর জন্য দায়ী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যাহতভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে সার্বিকভাবে এই খাতের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এর ফলে পুরো অর্থনীতিই এখন ঝুঁকির মুখে।
সুশাসন ভয়াবহভাবে উপেক্ষিত হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজেদের নীতিমালা ও জবাবদিহিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে নিজের পছন্দমতো ব্যবহার করার ফলে নিঃসন্দেহে আমাদের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ফাটল ধরতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন অর্থনীতিতে। আমরা তাকে অনুরোধ জানাই, তিনি যেন উপরে উল্লেখ করা সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তার নতুন মেয়াদ শুরু করেন।
নিরঙ্কুশ বিজয়ে পথ যতটা সহজ হবে বলে মনে হয়, বাস্তবে ততটা নাও হতে পারে। বিজয় স্বাভাবিকভাবেই উজ্জ্বল ও আলোকদীপ্ত, কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অনিবার্যভাবেই অন্ধকারও নিয়ে আসতে পারে।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments