মাহফুজ আনামের লেখা: বক্তৃতায় ছড়ানো বিষ ও জনমনের উদ্বেগ

ভিজ্যুয়াল: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

আমরা আগেও বলেছি এবং আবারও বলছি—নির্বাচন এমন একটি সময়, যখন দেশের নাগরিকরা তাদের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে শাসক দল ও প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এই সময়টা মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের বদলে দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি বিষোদগারের সময়ে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েক বছর না হলেও অন্তত কয়েক মাস ধরেই আমরা শুনেছি যে আওয়ামী লীগ চায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে, আর বিএনপির দাবি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপি কোনো গবেষণামূলক, গভীর ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা না করে ঢালাওভাবে কেবল একটাই দাবি করে যাচ্ছে—সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তারা কেন প্রতিটি মন্ত্রণালয় ধরে ধরে সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করেনি, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।

অপরদিকে, বিএনপির দাবি পূরণে কোনো আইনি উপায় খুঁজে বের করা কেন সম্ভব না, সেই ব্যাখ্যা না দিয়ে সরকার শুধু বলে যাচ্ছে, 'সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।'

নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। অথচ আমরা এখনো জানি না যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে কী থাকবে—যদিও তারা ইশতেহারে যা বলে তার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকে এর বাস্তবায়ন। জনগণের প্রত্যাশা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ—এগুলো জানার জন্য কোনো দল কোনো ধরনের উদ্যোগে নিয়েছে বলে শোনা যায় না।

এর জন্য কোনো জরিপ, জনমত গ্রহণ, এমনকি ছোট বা বড় গ্রুপভিত্তিক আলোচনা হয়েছে—এমন কোনো তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাহলে কীভাবে এই দুই দলের নেতারা জানবেন যে আসলে সমস্যাগুলো কী এবং কোথায়?

নাগরিকের প্রত্যাশা ও উদ্বেগ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে খুব সম্ভবত তারা চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলবেন, 'আমরা জনমানুষের সঙ্গে আলোচনা করি না, কারণ আমাদের সেটা প্রয়োজন নেই। আমরা সব সময় তাদের সঙ্গেই আছি, তাদের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সবকিছুই জানি এবং আমরা সবসময় নিরলসভাবে তাদের জন্যই কাজ করছি। আপনারা—গণমাধ্যম, এনজিও, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা—এ বিষয়ে কিছুই জানেন না, তাই বারবার প্রশ্ন করেন।'

বিএনপি বলছে, 'দেশের মানুষ শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়', আর আওয়ামী লীগের দাবি, 'মানুষ জানে কারা উন্নয়ন করে'—এই দুই মন্তব্য বিবেচনায় নিলে আমরা যা বুঝি তা হলো, আমাদের সবজান্তা রাজনীতিবিদদের তৃণমূল পর্যায় থেকে বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই।

আগে দ্য ডেইলি স্টার জনমত জরিপ চালাত, বিশেষ করে যখন পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং কোনো দলই ক্ষমতায় জেঁকে বসে একনায়কসুলভ আচরণ করার সুযোগ পেত না। কিন্তু পরবর্তীতে যেকোনো ধরনের 'খারাপ' খবর দেখলেই শাসকগোষ্ঠীর অসহনশীল ও প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ দেখে আমরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।

বর্তমানে বিএনপি বলছে যে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। কারণ, তাদের সন্দেহ রয়েছে যে ক্ষমতাসীন দলটি সরকারি সংস্থাগুলোর অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনে কারচুপি করবে।

আওয়ামী লীগ বলছে, তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। সংবিধান স্পষ্টভাবেই বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সক্ষমতায় ক্ষমতায় থাকার অনুমতি দেয়।

এর আগে ১৯৯৪-৯৬ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দলের ওপর ভরসা করা যায় না—এই যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায়। সেই সময়ে বিএনপির যুক্তি ছিল, তারা 'সংবিধানের বাইরে' যেতে পারবে না।

মজার ব্যাপার হলো—২৭ বছর পরেও আমরা ঠিক একই সমস্যার জালে আটকে আছি, কিন্তু দল দুটির অবস্থান পুরোপুরি উল্টে গেছে।

এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে মারাত্মক রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, যা আমাদের গত ৩২ বছরের সব অর্জনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

আমাদের অর্থনৈতিক অর্জনগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানান কারণে হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই মুহূর্তে হামাসের হামলা ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপের মুখে পড়েছে এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে—যা খুবই উদ্বেগজনক। অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকা, লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি। এর সবই দেশের অর্থনীতিতে বড় হুমকি সৃষ্টি করছে।

এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে অত্যন্ত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগের দৃষ্টি শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে। অপরদিকে বিএনপি চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত কোনোকিছুই শুনতে রাজি না। উভয় দলই নিজেদের সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জগতে বাস করছে।

এ অবস্থায় আমাদের সামনে খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন—তাহলে দেশের অর্থনীতি, জনগণ ও উন্নয়ন নিয়ে কে ভাবছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই দুই দলের কেউই নয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘসময় ধরে বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের কারণে তা সম্ভব হয়। জেনারেল এরশাদের সরকারকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট উৎখাত করে। ১৯ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করায় দেশের সাধারণ মানুষও বিরোধী দলগুলোর সেই জোটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই অঙ্গীকারের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি এবং ধারাবাহিকভাবে দেশের রাজনীতিকে আমরা বর্গীয় শাসনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ী দল বলবে 'নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু' হয়েছে, আর পরাজিত দল বলবে 'ব্যাপক কারচুপি' হয়েছে। নিজেদের দাবির সপক্ষে তাদের কোনো তথ্য-প্রমাণেরও প্রয়োজন হয় না। 'শুধু আমরা ক্ষমতায় থাকলে গণতন্ত্র রক্ষা পায়' আর অপর পক্ষ ক্ষমতায় থাকলে কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়—এই একচোখা, সংকীর্ণমনা ও আত্মকেন্দ্রিকতার জগতেই বসবাস করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই 'জগতে' তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কোনোকিছুর জায়গা নেই, সেখানে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়ার মনোভাব নেই।

আমি প্রায়ই বিস্মিত হই, আমাদের স্বভাব বা মনস্তত্বে কী এমন আছে যা এমন আত্মবিধ্বংসী ও অনমনীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার দিকে ধাবিত করছে! দ্য ডেইলি স্টারের অংশ হয়ে গত ৩২ বছরে আমরা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখেছি একেবারে প্রথম সারির দর্শক হিসেবে। বিশেষভাবে দেখেছি দেশের দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের আচার-ব্যবহার। উভয় দলই যে বিষয়টি অব্যাহত রেখেছে তা হলো, অপর পক্ষের কাছ থেকে আসা যেকোনো দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা—তা যত যৌক্তিকই হোক না কেন। এখনো তারা রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে নিজ নিজ অবস্থানে অনড়।

যে রাজনৈতিক জগতে আমরা আছি সেখানে একটি প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নিজ দলের স্বার্থে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন, তাদের কাছে কি জনগণের স্বার্থ সামান্যতম জায়গাও নিতে পেরেছে?

ক্ষমতার প্রতি তাদের অনেক লোভ, মানুষের উদ্বেগে তাদের কিছু আসে যায় না, তারা বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে বহু দূরে, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা পরিবর্তনের প্রতি তাদের কোনো মনোযোগ নেই—যার ফলে তাদের প্রাধান্যের তালিকায় 'জনগণের স্বার্থ' সবার উপরে স্থান পায় না।

বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে প্রবেশ করছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাব্য নানামুখী ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে, তখন আমরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ঝগড়া করে চলেছি।

দুঃখজনকভাবে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হয়, বাংলাদেশে যদি সবচেয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের সেরা নির্বাচনও আয়োজন করা হয়, তারপরও পরাজিত পক্ষ কোনো না কোনো অজুহাতে নির্বাচনের ফল মেনে নেবে না। আমাদের রাজনীতি এতটাই শত্রুভাবাপন্ন প্রকৃতির। অথচ, আমরা যখন এসব সমস্যায় আটকে আছি, তখন মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলা দেশের তালিকায় পড়ে আছে বাংলাদেশ।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

9h ago