জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহ: ‘এ বছর আমাদের কোনো ঈদ আনন্দ নেই’

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিক ও ক্রুদের একজন ছেলে আইনুল হকের ছবি দেখাচ্ছেন মা লুৎফা আরা।

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক ও ক্রুর পরিবারে এবারের ঈদের কোনো আনন্দ নেই। জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নাবিকদের দ্রুত মুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস পেয়ে পরিবারগুলোর আশা ছিল, তাদের প্রিয়জনেরা হয়তো ঈদের আগেই দেশে ফিরবেন, অন্তত জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাবেন।

তবে তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি।

আশঙ্কা আর উদ্বেগের মাঝে তাই পরিবারগুলোতে নেই এবারে ঈদ উৎসবের আয়োজন। বরং নিদ্রাহীন এবং দুশ্চিন্তায় রাত কাটাচ্ছেন তারা।

গত ১২ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে ওই দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ (বাংলাদেশ সময়) সোমালিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ৬০ নটিক্যাল মাইল দূরে বাংলাদেশি জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ে।

জাহাজটি বর্তমানে সোমালি উপকূলের কাছে নোঙর করা।

গতকাল দুপুরে নগরীর আসকারদিঘির পাড় এলাকায় নাবিক আইনুল হকের ভাড়া বাসায় তার মা লুৎফা আরার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

বাসাটিতে শুনশান নীরবতা। ছোট ছেলে একটা কাজে বাইরে থাকায় বাসায় একাই ছিলেন তিনি।

'ঈদের যে আনন্দ, সেই আনন্দের মন মানসিকতা আমাদের এখন নেই,' বিষন্ন কণ্ঠে বলেন লুৎফা আরা।

'এই দুই ছেলে ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই।'

২০২১ সালে কোভিড মহামারিতে স্বামীকে হারানোর পর দুই ছেলেই তার সবকিছু। বড় ছেলে আইনুল জাহাজের চাকরিতে যোগ দেন ২০১৫ সালে। বাবার মৃত্যুর পর তিনি একাই ধরেন সংসারের হাল।

জলদস্যুদের কবলে জাহাজ এ খবর জানার পর থেকে চোখে ঘুম নেই এই মায়ের। এর মাঝে দুই বার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

'ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন, তারপরও ঘুম আসে না। কেবল দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। ছোট ছেলেকেও সারাক্ষণ বাসায় থাকতে বলেছি ,একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না।'

দুই সপ্তাহ আগে জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেন। সেখানে তারা পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করেন যে যত দ্রুত সম্ভব জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা তারা করছেন।

লুৎফা আরা জানান, ওই আশ্বাসের পর আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো ঈদের আগেই নাবিকেরা মুক্তি পাবেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আরও সময় লাগবে।

জলদস্যুরা গত শুক্রবার নাবিকদের বেশ কয়েকজনকে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়। ওই দিন ইফতারের পর ছেলে আইনুলের সঙ্গেও কথা হয় তার মায়ের।

'ছেলে জানিয়েছে তারা খুবই পানির কষ্টে রয়েছে। এখন পর্যন্ত সপ্তাহে কেবল দুবার গোসলের সুযোগ পাচ্ছেন নাবিকেরা। সামনে হয়তো সপ্তাহে একবারের বেশি সুযোগ নাও পেতে পারে। আমার ছেলে তো ইঞ্জিন রুমে কাজ করে তাই তার কষ্ট অনেক বেশি,' একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন মা।

'আমাদের শুধু একটাই প্রত্যাশা আমাদের সন্তানেরা যেন খুব দ্রুত নিরাপদে ফিরে আসে। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন জলদস্যুদের হেদায়েত দেয় যাতে তারা তাড়াতাড়ি জিম্মিদের মুক্তি দেয়। প্রার্থনা করি মালিকপক্ষ যেন সুন্দরভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে।'

আইনুলের পরিবারের মতো একই অবস্থা জিম্মি আরেক নাবিক মোহাম্মদ নুরুদ্দিনের বাড়িতে। তার মা, স্ত্রী এবং শিশু পুত্র থাকেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার দক্ষিণ শাহমিরপুর গ্রামে।

নূরের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, 'আমাদের জন্য ঈদের আনন্দটা এবার আসে নাই, ভাই। আমাদের স্বজনদের জন্য আমরা এতটাই দুশ্চিন্তায় আছি যে ঈদের কোনো প্রস্তুতি শপিং কিছুই হয়নি আমার কিংবা আমার শিশু পুত্রের মাঝেও ঈদের কোনো আনন্দ নেই।'

ঈদে জাহাজে থাকলেও আনন্দেই কাটান নাবিকেরা একসাথে পরিবারের মতো উদযাপন করেন। পরিবারের সদস্যদের সাথেও সেই আনন্দ ভাগ করে নেন, জানালেন জান্নাতুল।

কিন্তু এবার তো আর সেটা হচ্ছে না।

'আমার স্বামী নিরাপদে বাড়ি ফিরে এলেই আমাদের ঈদ,' বলেন জান্নাতুল।

জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমদের মা, স্ত্রী আর ছোট ভাই থাকেন চট্টগ্রাম শহরে।

তানভীরের মা জোসনা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মনে শান্তি না থাকলে ঈদের আনন্দ কীভাবে আসবে। ঈদের দিন শুধু প্রার্থনা করে যাব যেন সন্তান দ্রুত মুক্তি পায়, নিরাপদে দেশে ফিরে আসে।'

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা প্রায় শেষ। জাহাজের মালিক পক্ষ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি সুরাহা করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।

অবশ্য জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু জানায়নি।

কেএসআরএম গ্রুপের গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম ডেইলি স্টার কে বলেন, 'জলদস্যুদের সাথে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়।'

তবে তিনি জানান, ঈদের পর দ্রুততম সময়ে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি এবং ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মালিক কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshis worry amid US immigration crackdown

The United States has deported at least 31 Bangladeshis after President Donald Trump took a tough immigration policy.

6h ago