মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার কেন হয়, লক্ষণ ও শনাক্ত করার উপায়

বাংলাদেশে প্রতি বছর ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে মোট ক্যানসার আক্রান্তের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ওরাল ক্যাভিটি বা মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারে ভুগছেন। পুরুষের তুলনায় নারীদের ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসার বেশি হয়।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড মালিবাগ শাখার কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ ও মুখগহ্বর ক্যানসার কী
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ক্যানসার হলো অস্বাভাবিক কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ও সমষ্টি। যা শরীরের ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে উৎপত্তি হয় সেখানে থাকে না এবং আশপাশের টিস্যুকে সরাসরি আক্রান্ত করতে পারে। সব অস্বাভাবিক কোষগুলো যখন একীভূত হয় একই জায়গায় তখন সেখানে চাকা বা পিণ্ড মত ক্ষত তৈরি করতে পারে এবং দৃশ্যমান হয় এটাকেই ক্যানসার বলে। অন্যান্য ক্যানসারের মতোই এ বিষয়টি যখন মুখের ভেতর হয় তখন সেটিকে মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার বলা হয়।
মুখের ভেতর ম্যালিগন্যান্ট টিউমার অর্থাৎ অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির ফলে মুখ ও মুখগহ্বরে ক্যানসার হয়। মুখের ভেতরে এবং আশপাশের যেকোনো অংশে ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসার হতে পারে। যেমন- ঠোঁট, মাড়ি, গালের ভেতরের অংশ, তালু, জিহ্বাসহ মুখের ভেতরে যেকোনো স্থান।
প্রাথমিক শনাক্তকরণের উপায়
মুখের ভেতরে কোনো ধরনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত বা আলসার মুখ ও মুখগহ্বর ক্যানসারের সতকর্তা চিহ্ন। মুখের ভেতর আলসার হলেই যে ক্যানসার হবে বিষয়টি এমন নয়। তবে কোনো ধরনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রাথমিকভাবে একজন ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে, চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আলসার আক্রান্ত স্থান ক্যানসার আক্রান্ত কি না সেটি নিশ্চিত করবেন।
সতর্ক থাকতে হবে মুখের ভেতরে ক্ষত আছে কি না। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রতিদিন আয়নার মাধ্যমে মুখগহ্বর পরীক্ষা করতে হবে।
ওরাল হাইজিন মেনে না চলার প্রবণতা, টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট ব্যবহারে অনীহা ও অসচেতনতা বিদ্যমান। দেশের শতভাগ মানুষ এখনো টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট দিয়ে সকালে এবং রাতে কমপক্ষে দিনে ২ বার দাঁত ও মুখগহ্বর পরিষ্কার রাখার যে পদ্ধতি সেটি করছেন না।
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ওরাল হাইজিন বা মুখগহ্বরের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত না করা, আয়নার মাধ্যমে মুখের ভেতর কোনো ক্ষত আছে কিনা সেটি পরীক্ষা না করা, ডেন্টাল সার্জনের কাছে বছরে দুবার বার মুখ ও মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানোর প্রবণতাই ক্যানসার দেরিতে শনাক্ত হওয়ার পেছনে মূল কারণ। আর ক্যানসার দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণেই চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও রোগীর ঝুঁকি এবং মৃত্যু বেশি হয়।
কেন হয়
১. ধূমপান, ধোঁয়াহীন তামাকজাতীয় যেকোনো ধরনের দ্রব্য সেবন মুখ ও মুখগহ্বর ক্যানসার এর অন্যতম কারণ।
২. পান, জর্দা, সুপারি, সাদাপাতা, গুল, তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের পর মুখের ভেতর দীর্ঘসময় রেখে দেওয়া, কুলকুচি না করা, দাঁত ব্রাশ ও সঠিকভাবে মুখ পরিষ্কার না করার কারণে ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। এক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
৩. মুখের গহ্বরের আস্তর খুব নরম থাকে সেজন্য ভাঙা দাঁত, দাঁতের অস্বাভাবিক অবস্থান, কৃত্রিম দাঁত থেকে সৃষ্ট ক্ষত দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
৪. ওরাল হাইজিন মেনে না চলার প্রবণতা ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রমণ মুখ ও মুখগহ্বর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে যাদের মুখগহ্বর অপরিষ্কার থাকে তাদের এইচপিভি ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণ
১. মুখের ভেতর আলসার বা ক্ষত হওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে ভালো না হওয়া মুখ ও মুখগহ্বর ক্যানসারের লক্ষণ। এটি সাধারণ আলসার হতে পারে আবার ম্যালিগন্যান্ট আলসার বা ক্যানসার আক্রান্ত আলসার হতে পারে।
২. মুখে ব্যথা হয়।
৩. খাবার খেতে ও গিলতে অসুবিধা হয়।
৪. জিহ্বা নড়াচড়া করার সময় ব্যথা অনুভূত হয়।
৫. কথা বলতে কষ্ট হয়, কথা অস্পষ্ট হয়।
৬. ঢোক গিলতে কষ্ট হয়।
মুখের ভেতরে যেকোনো ধরনের ক্ষত বা ঘা হলে অবহেলা না করে প্রাথমিকভাবে ডেন্টাল সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে।
চিকিৎসা
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সব ক্যানসারের চারটি ধাপ রয়েছে। মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের চিকিৎসা রোগীর অবস্থা, ক্যানসারের ধরন এবং কোনো পর্যায়ে আছে তার উপর নির্ভর করে। অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয় ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসার চিকিৎসায়।
ক্যানসার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিলক্ষিত হলে ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন চিকিৎসা দেবেন। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসার হচ্ছে অস্ত্রোপচারের অযোগ্য, এ অবস্থায় রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি। প্রথমে কোনটি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করবেন সেটি নির্ধারণ করে থাকেন একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।
চিকিৎসার জন্য ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ যদি একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে ফলাফল ভালো হয়। প্রয়োজনে অনলাইন মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে একত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করলে রোগীরা লাভবান হবেন।
প্রতিরোধ
মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার প্রতিরোধে সবাইকে ওরাল হাইজিন মেনে চলতে হবে অর্থাৎ দাঁত, মুখ ও মুখগহ্বর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
শৈশব থেকে নিয়মিত সঠিকভাবে টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে। আয়নার মাধ্যমে মুখ ও মুখগহ্বরে ঘা বা ক্ষত পরীক্ষা করতে হবে। কোনো প্রকারের তামাক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
Comments