ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

‘জুলাই দীর্ঘ, ৩৬ দিনে মাস’

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে তীব্র গণঅভ্যুত্থানে রূপ পাওয়া যে জুলাই বদলে দিয়েছে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস, তার বর্ষপূর্তিতে রক্তাক্ত জুলাইকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন কবিতায় স্মরণ করেছেন এভাবে—

জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি—

গণবিদ্রোহ, প্রত্যেক দিন লাশ।

'মুক্তি-অথবা-মৃত্যু'র প্রস্তুতি—

জুলাই দীর্ঘ, ৩৬ দিনে মাস।

শুরুতে চাকরিপ্রত্যাশীদের এ আন্দোলন ছিল অহিংস। কিন্তু জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে তা সহিংস হয়ে উঠতে থাকে। এর ২০ দিনের মাথায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর সরকারদলীয় পান্ডাদের অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় বিপুল প্রাণ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের।

শিক্ষার্থীদের ঘোষণা ছিল, রক্তিম এ জুলাইতেই হাসিনার পতন নিশ্চিত করবে তারা। যে কারণে ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে নতুনভাবে তারিখ গণনা শুরু করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সে হিসাবে পতন নিশ্চিত হওয়ার পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছিল '৩৬ জুলাই'।

প্রলম্বিত এ জুলাইয়ের ১৪ তারিখ চীন ফেরত শেখ হাসিনার সেই আলোচিত সংবাদ সম্মেলন থেকে তার পতনের '৩৬ জুলাই' পর্যন্ত কালক্রমিক ঘটনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকছে এ আয়োজনে—

রোববার দুপুর সোয়া ৩টার দিকে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান শেষে প্রেফ ব্রিফিং করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাবি শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

১৪ জুলাই: আন্দোলনের গতিপথ বদলে দেওয়া হাসিনার সেই আলোচিত সংবাদ সম্মেলন

আগের দিন—২০২৪ সালের ১৩ জুলাই—শনিবার সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছিলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই।

ঘোষণা অনুসারে রোববার ১৪ জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।

এর মধ্যে ওই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সংবাদ সম্মেলনে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, 'একবার এ ধরনের আন্দোলন করল। শুধু আন্দোলন না, আওয়ামী লীগ অফিসে আক্রমণ, মানুষের ওপর আঘাত। দেশের জ্ঞানী-গুণী আছে, ঘরের ভেতরে বসে মিথ্যা-অপপ্রচার রেকর্ড করে ছাড়ল। এগুলো দেখে বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠিক আছে কোটা বাদই দিলাম। সেটার উদ্দেশ্য ছিল কোটা বাদ দিলে কী হয় (সেটা দেখা)?'

সেই কোটা বাতিলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন হাসিনা। বলেন, 'মামলার পরে কোর্ট কোনো রায় দিলে সে বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। সেখানে সমাধান করতে হবে। যারা আন্দোলন করছে, তারা তো আইন মানবেন না, আদালত মানবেন না, সংবিধান কী তারা চিনবেন না।'

সরকার কীভাবে চলে সে সম্পর্কে আন্দোলনকারীদের কোনো ধারণা নেই বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বলেন, '(কোটার প্রসঙ্গ) যখন আদালতে চলে গেল সেটার সমাধান সেখানেই হবে। আদালত তাদের সুযোগ দিয়েছে। তারা আদালতে যাক, বলুক। সেটি না করে, তারা রাজপথে সমাধান করবে। আমাকে বলছে। আদালত যখন কথা বলেছে, রায় হয়ে গেছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই, সংবিধানও বলে না, সংসদও বলে না, কার্যপ্রণালি বিধিও বলে না, কিছুই না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বাস্তবতা তাদের মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।'

কোটা আন্দোলন করার আগে আন্দোলনকারীদের পরীক্ষার ফলাফল দেখা উচিত ছিল মন্তব্য করে হাসিনা আরও বলেন, 'রাজপথে আন্দোলন করছে, করতেই থাকবে। তবে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। যতক্ষণ তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছে কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু এর বাইরে যখন কিছু করবে, পুলিশের গায়ে হাত তোলা, গাড়ি ভাঙচুর, আক্রমণ করতে যায়—তখন তো আইন আপন গতিতে চলবে। আমাদের কিছু করার নেই।'

একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা না পেলে, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না? অপরাধটা কী?'

তার বক্তব্যের এই অংশটুকু ক্ষুব্ধ করে তোলে আন্দোলনকারী, তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার'

সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নানা স্লোগান দেন। সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।

জমায়েতে শিক্ষার্থীরা 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার', 'তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার'সহ নানা স্লোগান দেন।

একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলা হয় জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপরেও।

রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হতে শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী টিএসসিতে আসেন।

রাজু ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: স্টার

এমন পরিস্থিতিতে ভোরে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ঘোষণা দেন, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা বক্তব্য সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে প্রত্যাহার না করলে তারা আন্দোলনে নামবেন।

ছাত্রলীগের অবস্থান, হুমকি

এর আগে রাতেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভকে ঘিরে ছাত্রলীগের একটি অংশ মধুর ক্যানটিনে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার নেতা-কর্মীরা মোটরসাইকেলে করে লাঠিসোঁটা নিয়ে মধ্যরাত থেকে জড়ো হন শাহবাগ এলাকায়। ছাত্রলীগ ছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরাও সেখানে ছিলেন। ক্যাম্পাসের আশপাশে তাদের দেখা গেলেও সে সময় তারা কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াননি। কিন্তু সরকার-সমর্থক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের এমন অবস্থানে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাতে শাহবাগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের একটি অংশও বিক্ষোভ করেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর টিএসসি এলাকায় তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খানসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দেখা যায়। পরে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রলীগ। মিছিলে 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' প্রভৃতি স্লোগান দেওয়া হয়। রাত তিনটার পর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রলীগ সমাবেশ করে।

ছাত্রলীগের সমাবেশে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, সোমবার থেকে বাংলাদেশের রাজপথে আর কোনো রাজাকার থাকবে না। প্রতিটি জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা, দেশে যারা নৈরাজ্য তৈরি করতে চায়, যারা লাখো শহীদের রক্ত নিয়ে তামাশা করবে, রাজপথেই এর ফয়সালা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা সমতাধর্মী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও যৌক্তিক রাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের অঙ্গীকারের কথা বলেছেন বলেও উল্লেখ করেন সাদ্দাম। বলেন, যারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করার চেষ্টা করে, তাদের জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ পুরোদমে প্রস্তুত রয়েছে।

সাদ্দাম আরও বলেন, আজকে যারা নিজেরা বলছে 'আমি রাজাকার' তাদের জন্য ছাত্রলীগ রাজাকার কোটা চালু করল। যারা রাজাকার কোটার আওতাধীন, তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েই ছাত্রলীগ ক্ষান্ত হবে। যেখানেই রাজাকারদের দেখা যাবে, সেখানেই প্রতিবাদ গড়ে তুলে তাদের আপন ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে।

'হাসিনা আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নোংরা খেলাটা খেলতে চেয়েছিলেন'

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সাম্প্রতিক এক লেখায় বলছেন, 'কোটা পুনরুদ্ধারের জন্য আদালতে রিট হলো। এটা সেই পুরোনো কৌশল। হাসিনা নিজে না করে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাঁর নোংরা খেলাটা খেলতে চেয়েছেন। একই খেলা খেলে তিনি আদালত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত সংবিধানের ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করিয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই ধারা বাতিল হলে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।'

ছবি: স্টার

'জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং বিবিসির তথ্যচিত্র' শিরোনামের ওই কলামে মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলছেন, 'বিচারালয়ে সেবাদাসের অভাব ছিল না। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ছাত্রসমাজ আর চাকরিপ্রত্যাশীরা ফুঁসে উঠল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এটি দমাতে আবারও সেই পুরোনো কৌশল। প্রথমে ভাড়াটে হেলমেট বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের পেটানো, ছাত্রাবাস থেকে বের করে দেওয়া, রাস্তায় তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চলল। প্রথমবারের মতো দেখা গেল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা এমনকি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত এই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে গেল। আন্দোলন চলে এল ক্যাম্পাসের বাইরে।

'পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, হেলমেট বাহিনী'

'এবার মাঠে নামল পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি। হেলমেট বাহিনী আন্দোলনকারীদের পেটায়, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের সুরক্ষা দেয়। তারপর তারাও যুদ্ধ ঘোষণা করে আন্দোলনকারীদের ওপর। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। জনসম্পৃক্তি বেড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে এটি প্রচণ্ড গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। হাসিনা সরকারের পতন হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

BNP now a protector of Mujibism, says Nahid

'BNP is now protecting the ideology of Mujibism like the previous government. They are involved in corruption, extortion, and criminal activities just like the previous government,' says NCP chief

34m ago