চব্বিশের ১৯ জুলাই: পুলিশের গুলিতে বগুড়ায় প্রথম এক কিশোরের মৃত্যু

স্টার ফাইল ফটো

আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই রাতে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। পরদিন ১৯ জুলাই সকাল থেকে বগুড়া সাতমাথায় মানুষকে খবরের কাগজের দোকানগুলোতে দেখা যায়। আগের দিনের সংঘর্ষে কত মানুষ মারা গেছেন, তা জানার জন্য সকালে উঠে অনেক মানুষ সেখানে ভিড় করেন।

ওই দিন সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত শহরের কোথাও আন্দোলনকারীদের দেখা যায়নি। বিকেল ৪টার দিকে বগুড়া সেউজগাড়ী আমতলীর মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী-জনতা। বিকেল ৫টার পর ডিবি পুলিশ, জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের সদস্যরা সেখানে গেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়।

বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে পুলিশ সেখানে জলকামান দিয়ে গরম পানি ছিটিয়ে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর পুলিশ বগুড়া রেলস্টেশনের ঠিক সামনের রাস্তার পূর্বদিকের সড়কে অবস্থান নেয়। পুলিশের পেছনে কিছু স্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ আরও দুইবার সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়।

স্টার ফাইল ফটো

ওই সময় জলকামানের গরম পানিতে পা পিছলে পড়ে যান বগুড়া হাড্ডিপট্টি এলাকার সিয়াম শুভ নামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। সিয়াম রাস্তা থেকে ওঠার সময় তার সারা শরীরে গুলি লাগে বলে জানান সঙ্গে থাকা একাধিক শিক্ষার্থী। পুলিশ ৫০-৬০ ফিট দূর থেকে গুলি করে বলেও তারা জানায়। পরে সিয়ামকে কাছেই অবস্থিত বগুড়া নার্সিং হোমে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে বগুড়া নার্সিং হোমে গিয়ে দেখা যায়, সিয়ামের মরদেহ শনাক্তের জন্য রাখা। সেখানে উপস্থিত বগুড়া নার্সিং হোমের চিকিৎসক মশিহুরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছররা গুলি সিয়ামের দুই চোখ ও মাথাসহ সাড়া শরীরে ঢুকেছে। ওই সময় পড়ে গিয়েও মাথায় তীব্র আঘাত পেয়েছে সে।

এরপরে আন্দোলনকারীরা মিছিল করতে করতে সিয়ামের মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শজিমেক) নিয়ে যায়। সেখানেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এই সময় জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার মো. সালেহর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিয়ামের সারা শরীরে ছররা গুলি ঢুকে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

স্টার ফাইল ফটো

শজিমেকে রাত ৮টার পরে সিয়ামের পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়। সিয়াম শহরের হাড্ডিপট্টি এলাকার বাসচালক আশিকের ছেলে। আশিক সিয়ামের পালক বাবা। সাত বছর আগে আশিক ও তার স্ত্রী শাপলা খাতুন বগুড়া রেলস্টেশন থেকে সিয়ামকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিয়ামের আসল মা-বাবা মারা গেছেন।

ওইদিন রাতে এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিয়াম ফেলে দেওয়া বোতল সংগ্রহ করে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করতো। ঘটনার দিনে দুপুরে ১০০ টাকা নিয়ে সেউজগাড়ী এলাকায় একটি হোটেলে ভাত খেতে গিয়ে কীভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সেটা জানে না তার পরিবার।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সিয়ামের আসল বাবার নাম মৃত বাবলু মিয়া। তার বাড়ি বগুড়া নন্দীগ্রাম উপজেলার কড়িহাট গ্রামে।

স্টার ফাইল ফটো

সিয়ামের মৃত্যুতে পুলিশের ভিন্ন বক্তব্য

সেউজগাড়ী আমতলার এই ঘটনায় বগুড়া সদর থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. জাকির আল আহসান বাদী হয়ে ২১ জুলাই সদর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সিয়ামের বয়স লেখা হয়েছে ২০ বছর। পিতার নাম দেওয়া হয়েছে মৃত বাবু, গ্রামের নাম দেওয়া হয়েছে দরিয়াপুর, উপজেলা নন্দীগ্রাম। পালিত পিতার নাম দেওয়া হয়েছে আশিক, মায়ের নাম মোছা. শাপলা খাতুন, ঠিকানা হাড্ডিপট্টি, বগুড়া।

মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, সিয়াম আসামিদের ছোড়া বিস্ফোরিত ককটেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে মুখ, বুক, পেট, দুই হাত ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত পায়। আহত সিয়ামকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে শজিমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করে।

এই মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশ এই সময় মোট ৫০০ রাউন্ড লেডবল, ৪০৭ রাউন্ড রাবার বুলেট, ২০৮টি গ্যাসসেল ও ১৬টি সাউন্ড গ্রেনেড ফাঁকা ছুড়ে ওই স্থানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

একইদিন ঢাকাতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনে অনেক মানুষ মারা যান। সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়।

স্টার ফাইল ফটো

২০ জুলাই সকাল থেকে বগুড়ার সাতমাথা এলাকায় আন্দোলনকারীদের দেখা না গেলেও দুপুর ২টার সময় সেউজগাড়ী আমতলী এলাকায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। সেই সময় সেখানে স্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ঠিক ২টার সময় আমতলী এলাকায় প্রায় ২০০ জন ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে সাতমাথা-আমতলী এলাকায় বসে পড়েন। ঠিক তখন সেখানে উপস্থিত হয় সেনাবাহিনীর গাড়িবহর। রাস্তায় আন্দোলনকারীদের দেখে তারা থামেন।

সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। তাদের রাস্তা দ্রুত খালি করতে বলে। কিন্তু ছাত্র-জনতা প্রায় ৩০-৩৫ মিনিট তাদের গাড়িবহর আটকে রাখে। তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের দুই শিক্ষার্থী সামনে এগিয়ে গিয়ে সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন। কেন সিয়ামকে এভাবে মারা হলো সেটার প্রতিবাদ করেন। ওই সময় আন্দোলনকারীরা 'এই মুহূর্ত থেকে দেশে সেনা শাসন দরকার' বলেও স্লোগান দেন।

আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে পুলিশের ফোর্স এসেছে, তাদেরকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিতে হবে। সেনাবাহিনীর অফিসাররা তাই করেন। পরে আন্দোলনকারীরা রাস্তা থেকে সরে গেলে সেনাবাহিনীর গাড়িবহর রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের দিকে যাত্রা করে।

বগুড়ায় কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা বাদী হয়ে বগুড়া সদর ও শেরপুর থানায় ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেন। এসব মামলায় আসামি করা হয় মূলত বিএনপি এবং জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীদের। জেলে থাকা স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত নেতাদেরকেও এসব মামলার আসামি করা হয়।

এসব মামলায় ২৯ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৯০ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন সেই সময়ের বগুড়ার পুলিশ সুপার জাকির হাসান।

Comments

The Daily Star  | English

Audits expose hidden bad loans at 6 Islamic banks

Asset quality reviews by international auditors KPMG and Ernst & Young have revealed that six Shariah-based banks in Bangladesh are in a dire financial state, with non-performing loans (NPLs) skyrocketing four times greater than previously reported.

7h ago