শিশু নির্যাতন ও আমাদের ভেঙে পড়া সামাজিক রীতি

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি হচ্ছে 'অধিকারের'। সম্পদ, পৈত্রিক প্রভাব অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে (শেষেরটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশি কার্যকর) কিছু মানুষ মনে করেন, তাদের যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আছে। যেমন: অন্যদের অপমান করা, ছোট করা এবং প্রকাশ্যে বিষোদগার করা। বিষয়টা এমন— যত বেশি কুৎসিত আচরণ করবে, ততই যেন বলিষ্ঠ হয় তাদের পেশিশক্তির প্রদর্শন। আমরা দরিদ্র শিশুদের সঙ্গে যে আচরণ করি, তা এ ধরনের বৈষম্যের কুৎসিত চেহারাকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি বেদনাদায়কভাবে ফুটিয়ে তোলে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার স্থানীয় পৌরসভা মেয়রের বিরুদ্ধে ৭ ও ১১ বছর বয়সী ২ শিশুকে নির্যাতন, মারধর ও হাত বেঁধে ২ কিলোমিটার পথ হাঁটানোর অভিযোগ উঠেছে। মেয়রের দাবি, ওই ২ শিশু একটি পরিত্যক্ত কারখানা থেকে কিছু পুরনো যন্ত্রপাতির জং ধরা নাট-বল্টু 'চুরির চেষ্টা করছিল'। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় বেশ কিছুদিন ধরেই কারখানাটি উন্মুক্ত পড়ে আছে। ওই ২ শিশু সেখানে খেলতে গিয়ে কয়েকটি নাট-বল্টু হাতে তুলে নেয়। তারা হয়তো সেগুলো নিয়ে খেলতে চেয়েছিল। মেয়র দূর থেকে ঘটনাটি দেখতে পেয়ে রেগে যান এবং ওই শিশুদের মারধর ও নির্যাতন করেন।

এটা হঠাৎ রেগে গিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনা নয়। তিনি সেখানে তার ক্ষমতার প্রদর্শন করেছেন। ওই ২ শিশুকে তিনি হাত বেঁধে স্থানীয় বাজারে সবার সামনে ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘুরিয়েছেন। সেই সময় ওই শিশুদের অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা মেয়রের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চান। শেষ পর্যন্ত ওই শিশুদের ক্ষমা করা হয়, কিন্তু তার আগে তাদের মাথার চুল কেটে দিয়ে জনসমক্ষে চূড়ান্তভাবে অপমান করা হয়। এই শাস্তির কারণ হলো, তাদের ছোট চুল দেখে যেন মানুষ তাদের চোর হিসেবে চিনতে পারে এবং বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রূপ ও মৌখিক হয়রানির সুযোগ থাকে, যেন তাদের শাস্তিকে আরও দীর্ঘায়িত করা যায়।

প্রথমত, এটি সামাজিক শ্রেণি ও অবস্থানের বিষয়। আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি— ৭ ও ১১ বছর বয়সী ওই ২ শিশু যদি ওই মেয়রের মতো একই সামাজিক অবস্থান, সম্পদ অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী কোনো পরিবারের সন্তান হতো, তাহলে তিনি কখনোই তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারতেন না।

দ্বিতীয় কারণটিও ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মেয়র নিশ্চিত ছিলেন, ওই ২ শিশুর অভিভাবক বা পরিবারের সদস্য পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কারণ, সেখানেও হয়তো মেয়রের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তা ছাড়া, তাদের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থার সঙ্গে কোনো ধরনের 'যোগাযোগ' নেই, যারা মেয়রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে।

বাকি রইলো শুধু গণমাধ্যম। আমরা স্থানীয় সাংবাদিকদের সাধুবাদ জানাই, কারণ তারা সর্বান্তকরণে ওই ৭ ও ১১ বছর বয়সী ২ শিশুর ওপর হওয়া সহিংসতার বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

ওই শিশুদের ওপর মেয়রের এই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট প্রভাব সম্পর্কে এখনই, এমনকি অদূর ভবিষ্যতেও জানা সম্ভব নয়। মারধর, নির্যাতন, হাত বেঁধে রাখা এবং মহল্লার সবার সামনে ঘোরানোর কারণে তাদের ভেতরে যে কষ্ট তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হবে। হাত বেঁধে মহল্লায় সবার সামনে ঘোরানোর কারণে তারা যে কষ্ট পেলো, তা মারধরের কারণে পাওয়া শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আজীবন তাদের মনে এই ঘটনার ক্ষত থেকে যাবে।

বাবা-মা, পরিবার ও খেলার সঙ্গীদের সামনে এ ধরনের অপমান তাদের মনে গভীর বেদনা ও লজ্জার কারণ হবে। এই কারণে তাদের মাঝে কখনোই হয়তো স্বাভাবিক আত্মসম্মানবোধের জন্ম হবে না। এ ধরনের আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা শিশুর আত্মসম্মানবোধের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। নিঃসন্দেহে আমাদের আড়াইহাজার উপজেলার মেয়র শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধের জগত থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, এ ঘটনার গুরুত্ব বোঝা তো দূরের কথা, আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছি, সেটাও হয়তো তিনি বোঝেন না।

আমি বিস্মিত যে, এই মেয়র কীভাবে এবং কার কাছে জবাবদিহি করবেন? এই সংবাদ প্রকাশের পর তিনি লুকিয়ে আছেন এবং অপেক্ষা করছেন, কখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা কমবে এবং গণমাধ্যম এ নিয়ে আগ্রহ হারাবে।

এমন কোনো কাঠামো বা প্রক্রিয়া কি আছে, যার মাধ্যমে ওই ঘটনার তদন্ত হবে, স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হবে এবং অভিযুক্ত মেয়রকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? এমন কোনো কর্তৃপক্ষ কি আছে, যার কাছে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরা ন্যায়বিচারের জন্য যেতে পারবেন?

আমার উপলব্ধি হচ্ছে, এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। লাগামহীন ক্ষমতার অপব্যবহার, পুলিশের আইনি হয়রানি ও স্থানীয় মাস্তানচক্রের হুমকির মধ্যে দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন মানুষ সার্বক্ষণিক দাসত্বের অনুভূতি নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে, সেটা ভেবে আমি শিউরে উঠি। নারী ও শিশুদের জন্য এই দৃশ্যপট যেন দুঃস্বপ্ন।

কাগজে-কলমে এ দেশের ক্ষমতাহীনদের নিরাপত্তায় আইন রয়েছে। কিন্তু আমাদের আইনি ব্যবস্থা এতটাই জটিল, নানা স্তরে বিভক্ত, দুর্বহ, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল যে, দরিদ্ররা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আইনের সহায়তা নেওয়ার চেয়ে তা মেনে নেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন।

নিপীড়িত মানুষের সহায়তায় রাজনীতিবিদরা যে এগিয়ে আসবেন, তাদের কাছেও এই জনগোষ্ঠীর মূল্য থাকে কেবল ভোটের সময়, ৫ বছর পর পর। বাকি সময়টাতে ভোটারের কণ্ঠস্বরের চেয়ে অর্থ ও পেশিশক্তির জোর বেশি থাকে।

আমরা এমন অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে ক্ষমতাশালীরা চোর সন্দেহে ছোট ছোট শিশুদের মারধর ও নির্যাতন করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দরিদ্রদের বিষয়ে আমাদের পক্ষপাত রয়েছে, যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সহিংসতা হলে আমরা সহজভাবেই সেগুলো মেনে নিতে পারি।

অত্যন্ত বিকৃত চিন্তাধারা থেকে একটি সাধারণ যুক্তি তৈরি হয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে, টাকা বা অন্য যেকোনো বস্তু যদি হারিয়ে যায় এবং সেখানে যদি কোনো দরিদ্র পরিবারের শিশু উপস্থিত থাকে, তাহলে তাকেই আমরা চোর সাব্যস্ত করি। যুক্তি যতই দুর্বল হোক না কেন, তাকে মারধর ও নির্যাতন করলেই চুরির দায় সে স্বীকার করবে। এমন মারধর ও নির্যাতন করলে শিশুটি যে দায়টা 'স্বীকার' করবে, সে বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে? তা ছাড়া, তার আর কিবা করার থাকে?

গত কয়েকদিনের ৩টি ঘটনা থেকে আমরা দেখেছি, কত সহজে ও কতটা হেলাফেলায় আমরা শিশুদের নির্যাতন করি, শারীরিক শাস্তি দেই এবং মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত করি। চট্টগ্রামে ৩ পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কী কঠিন শাস্তি! দায়িত্ব পালনকালে তারা ২ শিশুকে চোর সন্দেহে নির্যাতন করেন। পুলিশ সদস্যরা ওই শিশুদের একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে মারধর করেন। যশোরে রেস্তোরাঁ থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় এক বাবুর্চির গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় রেগে গিয়ে ১০ বছর বয়সী এক শিশুর হাতের ওপর গরম তেল ঢেলে দেওয়া হয়। ফেনীতে অপরাধের শাস্তি হিসেবে শিকলে বেঁধে রাখা ও নির্যাতনের শিকার কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

২০১৯ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের কাছ থেকে সহিংস শাস্তি ও আগ্রাসী ব্যবহারের শিকার হয়। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, 'সহিংসতার ধরন যেমনই হোক না কেন, এ অভিজ্ঞতার গুরুতর ও স্থায়ী প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে, শৈশবে সহিংসতা থেকে তৈরি উদ্বেগ শিশুদের মস্তিষ্কের প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।'

২০২২ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের পথশিশুদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত এবং ২১ শতাংশ শিশু মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ জানিয়েছে, ১০ বছর বয়স থেকে তারা মাদক গ্রহণ করছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায়, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিশুদের ৬৪ শতাংশেরই দৈনন্দিন জীবনযাপন ও নিজেদের যত্ন নেওয়ার বিষয়েও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাদক চোরাকারবারিরা তাদের কাছে মাদক বিক্রি করে এবং তাদেরকে মাদক বহনের মতো কাজে ব্যবহার করে। ঢাকা কিংবা সারাদেশে কত পথশিশু আছে, তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে গবেষকরা মনে করছেন এই সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ১০ লাখ পথশিশুর ৫৬ শতাংশ ধরলে এই সমস্যা কত বিস্তৃত সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

এ ছাড়া, আমাদের সমাজে শিশু অপহরণ, বেআইনিভাবে কারাগারে আটকে রাখা ও যৌন নির্যাতনের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। মেয়ে শিশুরা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছেও নিপীড়নের শিকার হয়— এই লেখায় সে বিষয়টির উল্লেখই করিনি। এ ছাড়া, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যে মৌলিক অবিচার ও বৈষম্য করা হয়, সে ব্যাপারেও আলোচনা করিনি।

মুখে মুখে আমরা শিশু অধিকার নিয়ে অনেক কিছুই বলি। আমরা সেই দেশ, যারা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের মূল্যবোধসম্পন্ন আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছি। সবার আগে যে দেশগুলো ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে সই করেছিল, আমরা তাদের মধ্যে অন্যতম। সন্দেহাতীতভাবে আমরা সব আন্তর্জাতিক ফোরামে যোগ দিতে পছন্দ করি, সেখানে আমাদের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা জোর গলায় ঘোষণা করি।

প্রশ্ন হচ্ছে, জাতি হিসেবে যেখানে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলতে কখনই ক্লান্ত হই না, সেখানে শিশুদের নিরাপত্তা, তাদের বেড়ে ওঠার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক ও ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিতের জন্য আসলে আমরা কী করেছি? এ প্রশ্নের সত্য উত্তর দেওয়ার সময় এসেছে।

শুরুতে যেমন বলেছি, এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে অধিকারের। শুধু ধনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের 'অধিকার' আছে, দরিদ্র ও ক্ষমতাহীনদের কোনো 'অধিকার' নেই। আমরা যে বিভাজিত সমাজ গড়ে তুলছি, তার মূলে রয়েছে এই বৈষম্য। একই কারণে আমরা খুব সহজেই দরিদ্র শিশুদের অবহেলা করি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তথা দেশের ভবিষ্যতের যত্ন নেওয়ার প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন না আনতে পারলে যত উন্নয়নই হোক না কেন, স্বস্তিতে থাকতে পারব না।

এই বিষয়টি শিশু অধিকার কর্মীদের কাজ মনে করে এড়িয়ে না যাওয়ার অনুরোধ রইলো। বস্তুত একটি মানবিক সমাজ গঠন এবং আমাদের আরও উন্নত মানুষ হয়ে উঠতেই এটা প্রয়োজন।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments