দুই দলের এক দফায় দেশের না ‘দফারফা’ হয়

যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি করেন না; যারা সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন—সেই আমজনতার দফা কী? তারা কী চান? প্রধান দুই দলের নেতারা কি জনগণের প্রত্যাশা বা জনগণের কী দফা
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানপোড়েনের মধ্যে যেদিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকায় এলেন, তার পরদিনই রাজধানীতে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল।

সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নয়াপল্টনে হয় বিএনপির সমাবেশ। এর অদূরেই জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের সামনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ।

বিএনপি চায় সরকারের পদত্যাগ। এটি এখন তাদের একমাত্র দাবি। মানে এক দফা। আওয়ামী লীগেরও এক দফা। শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারো অধীনে নির্বাচন হবে না। অর্থাৎ দেশের প্রধান দুই দলই এখন এক দফায় এসে স্থির হয়েছে। কেউ কেউ রসিকতা করে একে বলছেন 'দফারফা'।

প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই এক দফার ভবিষ্যৎ কী? যদি প্রধান দুটি দল তাদের এক দফায় অনড় থাকে, তাহলে তাতে দেশের 'দফারফা' হবে কি না? উপরন্তু যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি করেন না; যারা সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন—সেই আমজনতার দফা কী? তারা কী চান? প্রধান দুই দলের নেতারা কি জনগণের প্রত্যাশা বা জনগণের কী দফা—সেটি কখনো জানার চেষ্টা করেছেন?

প্রসঙ্গত, গত ১২ জুলাই বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দাবি তুলে ধরে বলেন, 'আমরা যারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজকে আমরা একটা যৌথ ঘোষণা দেব যার যার জায়গা থেকে। সেই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণআন্দোলনের এক দফার ঘোষণা। আর কোনো দফা নাই।'  এই এক দফা দাবিতে সমমনা দল ও জোটকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে আগামী ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশে পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপির এই একদফা ঘোষণার পরে আওয়ামী লীগও তাদের শান্তি সমাবেশ থেকে পাল্টা এক দফা ঘোষণা করে বলে যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে এবং শেখ হাসিনাই সেই সরকারের প্রধান থাকবেন। অর্থাৎ বিএনপির যে প্রধান দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন—আওয়ামী লীগ সেই দাবি চূড়ান্তভাবে নাকচ করে দিল। অতএব এই ইস্যুতে বড় দুই দলের মধ্যে যে আলোচনা বা সংলাপ হবে—আপাতত তারও সম্ভাবনা কম?

এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্ন:

১. যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে কি বিএনপি অংশ নেবে?

২. বিএনপি কি নির্বাচন বর্জন বা বয়কট করে সেটি প্রতিহত করতে চাইবে? নির্বাচন প্রতিহত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি এবং জনমত কি বিএনপির সঙ্গে আছে?

৩. যদি বিএনপি নির্বাচন বয়কট বা বর্জন করে, তাহলে ওই নির্বাচন কি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? যদি গ্রহণযোগ্যতা নাও পায়, তাতেও কি আওয়ামী লীগের পুনরায় সরকার গঠনে কোনো অসুবিধা হবে?

৪. যদি বিএনপি ও তার সমমান দল এবং বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তথা সরকার অনঢ় থাকে, তাহলে দেশে কি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে? যদি হয় তাহলে সেই সংকটের পরিণতি কী হবে? কেননা কোনো দল যদি ছাড় না দিয়ে নিজের জায়গায় স্থির থাকে, তাহলে আদৌ সংঘাত এড়ানো যাবে কি? আর যদি সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয় সেটি প্রধান দুই দল ও জোট তো বটেই, সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য আদৌ কি কল্যাণ বয়ে আনবে?

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং বিরোধের ফলে অরাজনৈতিক কোনো গোষ্ঠী সামনে চলে আসে এবং কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না। এরকম পরিস্থিতি যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনে না, সেটি বারবার প্রমাণিত। সুতরাং প্রধান দুই দল নিজেদের এক দফা দাবিতে অনড় থাকলে তাতে যে দেশের দফারফা হবে—তাতে সন্দেহ কম। 

জনগণের দফা কী

প্রশ্ন হলো, দেশের প্রধান দুই দলের এখন এক দফা কী হওয়া উচিত? এক দফা হওয়া উচিত এরকম: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে দুর্নীতিতে লাগাম দিয়ে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। যেখানে শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন মুখ্য নয়, বরং কম খেয়ে পরে হলেও যে ব্যবস্থাটি কল্যাণকর, মানবিক, সহনশীল এবং যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষ নির্ভয়ে ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু এই এক দফা বাস্তবায়নে কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনোদিন একমত হবে?

পরিশেষে, রাজনীতির মাঠ ও মঞ্চে প্রধান দুই দল যে কথাই বলুক এবং নিজেদের এক দফায় যতই অনড় আছে বলে মনে হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে কি কোনো আপসফা হতে পারে? সেক্ষেত্রে দুই দলেরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কেননা দিন শেষে ব্যক্তির চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে যে দেশ ও জনগণ বড়—সেই উপলব্ধিটা জরুরি। রাজনীতিবিদদের কাছে যদি দেশ ও জনগণের চেয়ে দল কিংবা ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠে, তাহলে তার খেসারত দিতে হয় দেশ এবং দেশের সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশকে এরকম খেসারত আর দিতে না হয়, সেটিই প্রত্যাশা।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

 

Comments