ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সুবিধা নিচ্ছে কে

ডিজিটাল আইন প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকার বা ক্ষমতাবানরা অসন্তুষ্ট হয় বা বেজার হয়, এমন কোনো সংবাদ বা প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধই এই আইনের লক্ষ্য। ফলে অনেকে মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে এই আইনটির শিরোনাম হওয়া উচিত ‘ক্ষমতাবানদের সম্মান সুরক্ষা আইন’।

ধর্মের নামে ব্যবসা নতুন কিছু নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পীর ও তাদের দরবারের বিরুদ্ধে নানারকম অনিয়ম ও প্রতারণার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। 

এর মধ্যে শুধু রাজধানীর রাজারবাগ পীরের বিষয়ে কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে নজর দেওয়া যাক:

১. রাজারবাগ পীরের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ: ডয়েচেভেলে, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

২. রাজারবাগ দরবার শরীফের সম্পদ ও জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে কি না তদন্তের নির্দেশ: যুগান্তর ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

৩. মুসলমানদের করোনা হয় না এমন ফতোয়া দেন রাজারবাগের পীর: প্রথম আলো, ০৭ ডিসেম্বর ২০২১

৪. রাজারবাগ পীরের সব আস্তানা বন্ধের নির্দেশ হাইকোর্টের: সমকাল, ০৫ অক্টোবর ২১

ইন্টারনেটে খুঁজলে এরকম আরও অসংখ্য সংবাদ পাওয়া যাবে এই পীর ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। তার লোকজন এবার বিতর্কিত ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়েছেন আরটিভির সাংবাদিক অধরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। মামলাটি হয়েছে চট্টগ্রাম সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে। আদালত মামলাটি সরাসরি আমলে নিয়ে নোয়াখালীর সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, মামলা দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বরং ওই সাংবাদিককে নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।

শোনা যায়, এই পীরের সিন্ডিকেট মূলত টার্গেট করে সম্পদশালী ব্যক্তিদের। তাদের মুরিদ বানানোর পরে বেহেশতে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে নানাভাবে তাদের জমি-জমা ও সম্পদ হাতিয়ে নেয়। এতে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় গায়েবি মামলা। একের পর এক মামলা হতে থাকে। আর এই মামলাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রচার করেছিল আরটিভি। ওই অনুসন্ধানী রিপোর্টের শিরোনাম ছিল 'হালাল মামলার ফাঁদ'। এরপরেই রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। শুধু অধরা ইয়াসমিন নন, এর আগে এই মামলাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এনটিভির রিপোর্টার সফিক শাহীনের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল আইন ও মানহানির মামলা দিয়েছিল রাজারবাগের পীর সিন্ডিকেট।

অথচ এই পীর ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এরইমধ্যে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বা এই পীরের দরবার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে পারসেপশন, তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে; রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকায় ধর্মের নামে তারা যেসব অপকর্ম করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না—সেটিই প্রশ্ন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২১ সালের অক্টোবরে রাজারবাগ পীরের সব আস্তানা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি তার কোনো আস্তানা বন্ধ করেছে বা করতে পেরেছে? ওই আদেশে আদালত রাজারবাগ পীরের পৃষ্ঠপোষকতায় 'উলামা আঞ্জুমান বাইয়্যিনাত' অথবা ভিন্ন কোনো নামে কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কি না; পীরের প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা সম্পদ চিহ্নিত করা এবং তার সব সম্পদের উৎস সম্পর্কে বিশদ তদন্ত করতেও বলা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, এগুলোর অগ্রগতি কতটুকু? নাকি ধর্মীয় ইস্যু আছে বলে সরকারও এই পীর ও তার সিন্ডিকেটকে ভয় পায়?

প্রশ্নটা শুধু এই একজন পীর বা তার সিন্ডিকেটের অপকর্ম নিয়ে নয়। বরং প্রশ্নটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। সংসদে এই আইনটি পাস হওয়ার আগে থেকেই, অর্থাৎ খসড়া থাকাকালীনই এটি নিয়ে যেভাবে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে; এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে যেসব শঙ্কার কথা বলা হচ্ছিলো—ধীরে ধীরে সেগুলোই প্রমাণিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে আইনটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নাগরিকের সুরক্ষার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে, সেই আইনটির সুবিধা কারা নিচ্ছে? যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই, তারাই যদি এই আইনের সুবিধাভোগী হয়; ডিজিটাল প্লাটফর্মে নাগরিকের সুরক্ষার বদলে আইনটি যদি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের কথিত মানসম্মান সুরক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়—তাহলে এই আইনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, উঠছে।

২.

গত ১০ জুলাই প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম: জগন্নাথের শিক্ষার্থী খাদিজার জামিন আরও চার মাস স্থগিত থাকছে। খবরে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় কারাগারে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার জামিন প্রশ্নে আবেদন শুনানি চার মাসের জন্য মুলতবি (স্ট্যান্ডওভার) করেছেন আপিল বিভাগ।

খাদিজা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২টি মামলা হয়।

গত বছরের মে মাসে ২ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ২ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত বছরের ২৭ আগস্ট মিরপুরের বাসা থেকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে নিউমার্কেট থানার পুলিশ। তখন থেকে তিনি কারাগারে আছেন। আর দেলোয়ার বিদেশে পলাতক।

প্রশ্ন হলো—জগন্নাথের এই শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের জন্য কি এতটাই ভয়ংকর যে তাকে জামিন দেওয়া যাবে না? জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি রাষ্ট্রের কী এমন ক্ষতি করবেন? তিনি কি কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী যে জামিনে বের হয়েই কাউকে হত্যা করবেন? আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কী এমন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যাতে বিচারক তাকে আইনত জামিন দিতে পারেন না? খাদিজা এই আইনের কী এমন ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বা তার উপস্থাপনায় যে অনুষ্ঠানটি হয়েছে সেখানে বক্তা যেসব কথা বলেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রের কী এমন ক্ষতি হয়েছে কিংবা যার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তার যদি সম্মানহানি হয়েও থাকে, তারপরও এই মামলায় কি একজন নারী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং বয়সে তরুণ, তাকে জামিন দেওয়া যায় না?

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, 'খাদিজাতুল কুবরা ও দেলোয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মনগড়া, বানোয়াট, মিথ্যা, মানহানিকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন।'

প্রশ্ন হলো—একটি দেশের সরকার উৎখাত করা এতই সহজ? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা চাইলেই দেশের বৈধ সরকার উৎখাত করে দিতে পারেন? তাহলে আর দেশে রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ কী? ২ জন মানুষ মিলে কোনো একটি অনুষ্ঠানে কী বললেন না বললেন, তাতেই সরকার ভয় পাবে? এসব কথাবার্তা পাত্তা না দিলেই কী হয়?

অনলাইন প্লাটফর্মে কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল অথবা যেকোনো মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা এমনকি সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে রাজনীতিরই অংশ। গণতন্ত্রে এটুকু অধিকার স্বীকৃত। এসব বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিলেও কিছু যায় আসে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেওয়া মানেই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। যার সুবিধা নিচ্ছে একটি পক্ষ। একটি বিশেষ পক্ষকে সুবিধা দেওয়া এবং ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সমালোচনা প্রতিহত করার জন্যই কি এই আইন? আবার সরাসরি কেউ হয়তো ডিজিটাল মাধ্যমে না লিখে সংবাদপত্র বা কোনো বইপত্রে লিখলেন; সেই সংবাদ, বিশ্লেষণ এমনকি কার্টুনও ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আইনের এরকম ভয়াবহ অপপ্রয়োগ বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ।

৩.

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হওয়ার আগে থেকেই গণমাধ্যমকর্মী, লেখক ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এর বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেগুলো আমলে নেয়নি। পরে আইনটি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও সংশোধনের দাবির মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছেন। যদিও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।

সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছিল, এখনো বলা হচ্ছে যে, আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। গত বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হবে না। (সমকাল, ২১ মে ২০২২)। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই আইনটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক পোস্ট ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সিজিএস ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। তাতে উঠে এসেছে, এসব মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৫ জন সাংবাদিককে।

ডিজিটাল আইন প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকার বা ক্ষমতাবানরা অসন্তুষ্ট হয় বা বেজার হয়, এমন কোনো সংবাদ বা প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধই এই আইনের লক্ষ্য। ফলে অনেকে মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে এই আইনটির শিরোনাম হওয়া উচিত 'ক্ষমতাবানদের সম্মান সুরক্ষা আইন'। অর্থাৎ নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা বলা হলেও এই আইনের মূল ফোকাস যে সেটি নয়, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণিত।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার (মূলত অপব্যবহার) দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এখানে ব্যক্তি বলতে শুধু ক্ষমতাবানরাই—যেটি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments