গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থার রূপরেখা থাকুক আওয়ামী লীগের ইশতেহারে

দেশের সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, লেখক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা মিলে নিশ্চয়ই এমন একটি বিধানের সন্ধান দিতে পারেন যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক বিধান পুনরায় চালু করতে না হয়, আবার দলীয় সরকাররে অধীনেই অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গত ৩ অক্টোবর একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যুক্ত করার জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত বা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, এবার নিম্নআয়ের মানুষের প্রত্যাশা জেনে ইশতেহার দিতে চায় আওয়ামী লীগ। সেজন্য কৃষক, স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষসহ সমাজের নিম্নআয়ের মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রত্যাশা জানাতে দলের উপজেলা কমিটিগুলোকে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটি।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে তারা কাজ শুরু করেছে। নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নে এবার দলটির স্লোগান 'স্মার্ট বাংলাদেশ'।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের স্লোগান ছিল 'সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ'।

ওই ইশতেহারে তারা 'গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ' নামে একটি অধ্যায় রাখলেও কীভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থা চালু করা যাবে, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই নির্বাচনি ব্যবস্থাটিই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক সংকট।

১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে সেই বিধান বাতিল করা হয়।

এরপরে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনার মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেড়শোর বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মতো অভূতপূর্ব ঘটনাও ঘটে।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে এখনও সমালোচনা চলছে। আর এইসব সমালোচনার মূলে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না—এই দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটি প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

এসব কারণে নির্বাচনের আগে তিন মাসের জন্য জন্য একটি অনির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়াটা অগণতান্ত্রিক হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব রয়েছে এবং ক্ষমতায় থেকে যেহেতু কোনো দলই অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে—ফলে পদ্ধতি হিসেবে অগণতান্ত্রিক হলেও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে শুধু দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নয়, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও সমর্থন রয়েছে।

এই বিধানের পক্ষে সবচেয়ে বড় যে যুক্তি সেটি হলো, যে বাস্তবতায় সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল, সেই বাস্তবতার কি উন্নতি হয়েছে? অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে যে অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে বা হতে পারে, এটি কি সব রাজনৈতিক দল বিশ্বাস করে?

আইন ও যুক্তির কথা হলো, সংসদ যে বিধান সংবিধান সংশোধন করে বাতিল করেছে, সেই বিধানে নির্বাচন করতে হলে পুনরায় সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সেটি কেন সংশোধন করবে বা সেই বিধান কেন ফিরিয়ে আনবে? ক্ষমতাসীনদের আরেকটি যুক্তি হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার বলা হলেও ২০০৭ সালে দায়িত্ব নেওয়া এক-এগারোর সরকার টানা দুই বছর ক্ষমতায় থেকে এই ব্যবস্থাকে কলুসিত করেছে। বিতর্কিত করেছে।

এসব যুক্তিতে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, সংবিধানের মধ্যে থেকেই, অর্থাৎ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানে ফিরে না গিয়েও কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা যায়? অর্থাৎ এমন একটি ব্যবস্থা কি চালু করা যায় যেখানে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সব প্রতিষ্ঠান এমনকি মাঠ প্রশাসনও দলনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে?

দেশের সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, লেখক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা মিলে নিশ্চয়ই এমন একটি বিধানের সন্ধান দিতে পারেন যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক বিধান পুনরায় চালু করতে না হয়, আবার দলীয় সরকাররে অধীনেই অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগ কি তাদের এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও ব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতি দেবে?

এ কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট, তার অনেকখানি দূর করা সম্ভব শুধুমাত্র নির্বাচনি পদ্ধতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আমাদের দেশে এখন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সেটি হচ্ছে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)। অর্থাৎ যিনি মাত্র একটি ভোটও বেশি পাবেন, তিনিই বিজয়ী। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীরা যদি সারা দেশে মাত্র এক শতাংশ ভোটও কম পান, তারপরও সরকার গঠনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। অর্থাৎ বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন বাদে সবাই পরাজিত। অতএব সেই একজন হওয়ার জন্য সবার প্রাণপন লড়াই।

যেহেতু এই পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোট বেশি পেলেও তিনি জয়ী, সুতরাং এই একটি ভোট বেশি পাওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং নানারকম অপশক্তি প্রয়োগ করেন। মূলত এ কারণেই দেশের রাজনীতিও টু পার্টি পলিটিক্সে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভাবনায় শুধুই নৌকা আর ধানের শীষ। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে এই 'অসুস্থ' প্রতিযোগিতা কমে আসবে।

ব্যক্তির বদলে মানুষ যখন দলকে ভোট দেবে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে হানাহানি বন্ধ হবে। যে দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, তারা যেমন সংসদে থাকবে, তেমনি ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অর্থাৎ সংসদ হয়ে উঠবে সর্বদলীয়।

কিন্তু বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় আমাদের সংসদ মূলত একদলীয় এবং কখনও শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও অধিকাংশ দলই থাকে সংসদের বাইরে। অথচ তাদেরও কমবেশি ভোট আছে। সুতরাং যে অল্প সংখ্যক মানুষও ওই দলগুলোকে ভোট দিয়েছে, সেই ভোটারদের মতামতের কোনো মূল্যই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নেই।

মূলত এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (Proportional Representation) পদ্ধতি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনো ব্যক্তিকে নয়।

কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের রাজনীতি যেহেতু ব্যবসায়ী তথা 'পয়সাওয়ালা' এবং 'পেশীশক্তিওয়ালাদের' দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; ফলে তারা এরকম একটি অধিকতর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেতে চায় না। কারণ, আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে গেলে সংসদে ছোট বড় মাঝারি সব দলেরই সদস্য থাকবে। এতে অনেক শক্তিমান প্রার্থী বাদ পড়বেন। তখন নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ হবে। ব্যক্তির চেহারা দেখে মানুষ যেহেতু ভোট দেবে না—ফলে অযোগ্য লোকের পক্ষে শুধু টাকা আর পেশিশক্তি দিয়ে ভোটে জয়ী হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধানও বন্ধ করা জরুরি। সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী তিন শত সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।' প্রত্যক্ষ নির্বাচন মানে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা আবশ্যক।

সুতরাং আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনের জন্য যে ইশতেহার ঘোষণা করবে, সেখানে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা পরিবর্তন তথা অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে তাদের পরিকল্পনা তুলে ধরবে এবং তার মধ্য দিয়ে সত্যিই একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনি ব্যবস্থা চালু হবে—এই প্রত্যাশা কি খুব বেশি চাওয়া?

নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হচ্ছে গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র চর্চার প্রধান প্লাটফর্ম জাতীয় সংসদ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাতীয় সংসদ যেভাবে ব্যক্তিগত স্তুতির মঞ্চে পরিণত হয়েছে, তাতে সেখানে জনগণের অর্থেরই কেবল অপচয় হয় বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সুতরাং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার ঘোষণা করবে সেখানে এই সংসদীয় সংস্কৃতি পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত থাকা উচিত। অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পরিচালিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনগুলো যাতে ব্যক্তি ও দলের স্তুতি এবং বিষোদ্গারের প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত না হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য জনবান্ধব আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের কাজে ব্যবহৃত হয়, সেজন্য একটি ভাইব্র্যান্ট সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার থাকা উচিত।

সেইসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোকে সক্রিয় করা; স্বার্থের সংঘাত নেই এমন সংসদ সদস্যদেরকে কমিটিগুলোর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া; সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি পদে বিরোধী দলের কোনো সংসদ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতিও থাকা উচিত।

যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় যে দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে এবারের যে স্লোগান 'স্মার্ট বাংলাদেশ'—সেরকম স্মার্ট ইশতেহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সত্যিই তারা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে—এই প্রত্যাশা।

 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

 

Comments