জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য রাজনীতির অশনি সংকেত

জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের যেভাবে একক আধিপত্য তৈরি হচ্ছে তাতে রাজনীতি ধনীকশ্রেণীর হতে চলে যাবে। সংসদে অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষের অবস্থান থাকবে না। সেটা করতে হলে অবশ্যই এই বিষয়ে একটা নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা জরুরি।

রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। রাজনীতি ক্রমেই রাজনীতিকদের হাতছাড়া হয়ে ব্যবসায়ী ও আমলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের এক নেক্সাস তৈরি হয়েছে। রাজনীতির জন্য যা এক অশুভ সংকেত।

সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ হচ্ছে সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণের প্রাণকেন্দ্র। সেই সংসদের চিত্র ও চরিত্রের বিস্তার দেখলে সহজেই বোধগম্য হবে কেন এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদের ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদে ব্যবসায়ীদের সেই হার হয়েছে ৬৭ শতাংশ।

পাঁচ দশকে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। বর্তমান সংসদে ১৯৯ জন সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। তার মানে সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশই তারা।

দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ৯৩ শতাংশই ব্যবসায়ী। অথচ 'প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে সাড়ে ২৫ শতাংশ আইনজীবী, ২৩.৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪.৮৪ শতাংশ কৃষক, ৯.৮৯ শতাংশ শিক্ষক এবং ১২.৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন।' (রওনক জাহান)

বাংলাদেশের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা গোপন নয়। নির্বাচনে বৃহৎ দলগুলোর অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানাচ্ছেন, নির্বাচনে এবার যে ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থী মনোনয়ন তুলেছেন, তার মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এবং ক্রমেই তারা বিলুপ্ত প্রায়। ভবিষ্যতে অন্য কোনো পেশার প্রতিনিধিদের অস্তিত্ব সংসদে থাকবে না। রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদ বিলীন হয়ে যাবে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে।

কেন ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য হতে বেপরোয়া?

এ প্রসঙ্গে ডা. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নির্বাচনের আগে সিপিডির এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'যে যতবার নির্বাচন করেছে, তার আয় গাণিতিকভাবে তত বেশি বেড়েছে। মানে (তার আয়) বৃদ্ধির হারের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের বা নির্বাচিত হওয়ার একটা ইতিবাচক সম্পর্কে রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার পাওয়ার জন্য নাগরিক অধিকারের চেয়ে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ঢুকতে পারলে অ্যাকসেস টু স্টেট রিসোর্সেসের এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা। আপনি যদি তার সঙ্গে থাকতে পারেন তাহলে ভাগ-বাটোয়ারাটার কিছু অংশ আপনি পাবেন, যা নাগরিক হিসেবে পাবেন না। ওই অংশের অংশ হিসেবে আপনি এটা পাবেন। অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রকে আপনি অধিকারহীন করে দিয়ে, সংকীর্ণ গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার ও মালিকানা দিচ্ছেন। এটাই হচ্ছে এই চরিত্রের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় কুফল।'

মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। ওই মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মূল্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। অথচ, তিনি তার নির্বাচনী হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি।

শুধু তৈরি পোশাক খাতের অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া, দেশের প্রায় ২৫টি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী-পরিবারের সদস্যরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

সংসদে ব্যবসায়ীদের নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়নের উদাহরণ টেনে টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বড় সমস্যা হলো রাষ্ট্রের নীতিকাঠামো দখল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং, পোশাকশিল্প বা বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবসায়ীরা ঠিক করছেন নীতিকাঠামো কী হবে। সংসদের মৌলিক চরিত্র বদলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পরিবর্তে তারা নেতৃত্বের প্রশংসা ও নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন।'

টিআইবির গবেষণা বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে ২২তম অধিবেশনে (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল) আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন সরকারি ও বিরোধী দল মিলে ২৫ জন আইনপ্রণেতা, যা মোট সংখ্যার মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ব্যয়িত সময় প্রায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ সালে যুক্তরাজ্যে এ হার ছিল প্রায় ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৮-১৯ সালে ভারতের ১৭তম লোকসভায় এ হার ছিল ৪৫ শতাংশ।

এতে আরও বলা হয়েছে, একাদশ সংসদের প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশনে (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় আরও কম সময়, যা ছিল মোট সময়ের ৯ শতাংশ। সংসদীয় কার্যক্রমে বিষয়ভিত্তিক, প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে সরকার ও দলীয় অর্জন-প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রতি আক্রমণাত্মক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। অর্থাৎ আইনপ্রণেতারা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে খুব বেশি ভূমিকা রাখছেন না অথবা রাখতে পারছেন না।

একজন সংসদ সদস্যের কাজ কী? সাধারণভাবে একজন সংসদ সদস্যের কাজ চারটি।

১. আইন প্রণয়ন।

২. জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক ও মতামত তুলে ধরা।

৩. সরকারের আয়-ব্যয়, বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনার অনুমোদন দেওয়া।

৪. সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

কিন্তু সংসদে সেই কাজ কতটুকু হচ্ছে, টিআইবির তথ্যই সে কথা বলছে।

রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সংসদে ব্যবসায়ী ও আমলাদের একচেটিয়া আধিপত্য ও দাপটে রাজনীতিবিদ বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কি রাজনীতি করবে না? ব্যবসায়ীরাও তো এ দেশের নাগরিক। তাদেরও সংসদে যাওয়ার, রাজনীতি করার অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?

সেই আলোচনা বুঝতে টিআইবির গবেষণাই দেখা যেতে পারে।

এতে বলা হয়েছে, গত জাতীয় সংসদে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যা এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রস্তাব করা হয়নি। সংশোধিত আইনে ব্যাংক মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু সংসদে নয়, রাষ্ট্রকাঠামোতেও ব্যবসায়ীদের প্রভাব বিকশিত হচ্ছে। ঋণখেলাপির মতো বিষয়ে নীতি ব্যবসায়ীরাই ঠিক করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাজনীতি ও ব্যবসা একাকার হয়ে গেছে, মূলত অর্থসম্পদ বিকাশের জন্য ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছেন। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে বিনিয়োগ করছেন, তাদের জন্য মূল বিষয় মুনাফা অর্জন।

কোভিড মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে নিশ্চয়তার জন্য আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা, খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে, তা নিশ্চিত করা। ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমনে সরকারের অঙ্গীকারের কথাও তখন তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ইশতেহারে যে ১১টি বিষয়ের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে তা সংসদ নেতা কাদের নিয়ে এবং কাদের বিরুদ্ধে করতে চান? যারা ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণ, তাদের দিয়ে কি সেই কাজ হবে? তারা কি সেই কাজ করতে সংসদে গেছেন? উপরের উদাহরণ অবশ্য সেই কথা বলে না।

প্রথমে ঠিক করতে হবে রাজনীতি কাদের জন্য। তা যদি দেশ ও জনগণের জন্য হয়, সেখানে সংস্কার আনা জরুরি। রাজনীতিবিদরা যদি রাজনীতি করেন, জনগণের প্রতি যদি তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকে, তাহলে সেটা সম্ভব। ভক্ষককে রক্ষকের দায়িত্ব দিলে সে কাজ হবে না।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন গ্রামের কৃষক ও ছাত্র-যুবকরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই সংগ্রামের মূল নায়ক, যুদ্ধ পরিচালনা, অস্থায়ী সরকার, সেক্টর কমান্ডার ও বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মদানকারীদের নাম-পরিচয় সামাজিক অবস্থানই সে কথা বলে দেয়। কিন্তু অর্থবিত্ত নেই বলে আজ তারাই অবহেলিত, তাদের আত্মত্যাগের সুবিধাভোগী হলো ব্যবসায়ীরা।

লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে যদি সংসদে নারীদের ৫০টি আসন সংরক্ষিত থাকতে পারে, তাহলে অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও কেন এমন বিধান থাকবে না? মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন বরাদ্দ রাখতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কৃষিতে নিয়োজিত। জিডিপিতে তাদের ভূমিকা প্রায় ১৫ শতাংশ। সেবা-শিল্পের যে প্রবৃদ্ধি তাও আসলে শ্রমিকদের অবদান। অথচ সংসদে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়।

জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের যেভাবে একক আধিপত্য তৈরি হচ্ছে তাতে রাজনীতি ধনীকশ্রেণীর হতে চলে যাবে। সংসদে অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষের অবস্থান থাকবে না। সেটা করতে হলে অবশ্যই এই বিষয়ে একটা নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা জরুরি। কেননা দেশে শুধু ব্যবসায়ীরা বাস করেন না, অন্যান্য পেশার নাগরিকরাও বসবাস করেন। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ও তাদের শ্রেণীপেশার স্বার্থে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। সংসদে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন ও রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার প্রয়োজন।

 

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments