রাজনীতির খেলায় পুলিশ কেন বিতর্কিত?

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরস্থায়ী অথবা ক্রমবর্ধিষ্ণু দূরত্বের খেলায় শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই নন, জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া যে বাহিনীর প্রধান কাজ— এক অর্থে তারাও ভিকটিম হয়ে যাচ্ছে।

'পুলিশ পেছনে লেগেছে, বাথরুমের ছাদ-খালের পাড় এখন আমাদের থাকার জায়গা।'

গত ২৪ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের এই সংবাদ শিরোনাম দেখে কৌতূহল বেড়ে যায়। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন একজন নাগরিকের 'পেছনে' লাগবে? নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়াই তো তার কাজ। যদি সে অপরাধীও হয়, আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে এই 'পেছনে লাগা'র অভিযোগ কেন উঠবে?

যাকে উদ্ধৃত করে এই সংবাদ শিরোনাম, তার নাম মো. বশির। বয়স ৫৫। বাড়ি ভোলা সদরে। হাইকোর্টে এসেছিলেন আগাম জামিন নিতে। সেখানে বসে তার সঙ্গে আলাপ হয় দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদকের।

খবরে বলা হচ্ছে, গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার পরে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, সেরকমই একটি মামলার আসামি বশির। তিনি বিএনপির একজন কর্মী। যদিও তার দাবি, তিনি জানেন না তিনি কী অপরাধ করেছেন। তিনি এই মামলাকে 'গায়েবি' বলে অভিহিত করে বলেছেন, পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বাথরুমের ছাদ, সুপারি বাগান, খাল-বিলের পাড় এখন তাদের থাকার জায়গা।

ভোলা সদরে একটি ছোট দোকান চালাতেন বশির। কয়েক বছর আগে তার ব্রেন স্ট্রোক হয় এবং এখন তিনি চোখের সমস্যায়ও ভুগছেন। অথচ মামলার আসামি হওয়ার পরে ব্যবসা লাটে উঠেছে, শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

এর পরদিন ২৫ জানুয়ারি মানবজমিনের একটি খবরের শিরোনাম 'তিনিও হাইকোর্টে এসেছিলেন'। শিরোনামের সঙ্গে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বয়স্ক মানুষের ছবি। তার নাম মো. আলমগীর হোসেন মিলন। কোরআনের হাফেজ। মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করেন। ৫৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তিও ককটেল বিস্ফোরণ মামলার আসামি। অভিযোগ, তিনি পুলিশের ওপর ককটেল হামলা চালিয়েছেন। এই মামলায় জামিন নিতে এসেছেন হাইকোর্টে।

একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করেছেন, এই অভিযোগ কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সব সরকারই নানা ধরনের কৌশল নেয়। বিরোধী দলীয় নেতা থাকা অবস্থায় দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল—যা দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে।

তার অর্থ কি এই যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের এই নোংরা খেলা চলতেই থাকবে? বিশেষ করে জনগণের করের পয়সায় বেতন হয় রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, সেই বাহিনীকে নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিতের বদলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে? অবিশ্বাস্য অভিযোগে গায়েবি মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়রানি করা হবে? তার জীবিকার উৎস ধ্বংস করা হবে? তার সংসার তছনছ করে দেওয়া হবে?

বিএনপি কি কোনো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন যে সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কিংবা পুলিশের গ্রেপ্তার ও জেলখানার হাত থেকে বাঁচতে মাসের পর মাস ফেরারি জীবনযাপন করতে হবে? একটি বৈধ রাজনৈতিক দলের কর্মী কি ব্যবসা বাণিজ্য বা চাকরি করে নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন না? বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এর আগে আর কখনো এমন গণহারে দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকদের হয়রানির এমন অভিযোগ কি উঠেছে?

২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম 'মামলার পাহাড়ে বিএনপি'। খবরে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৫৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়। আর এসব মামলার কারণে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। বাধ্য হয়ে তাদের আদালতে সময় দিতে হচ্ছে। পুলিশের ভয়ে এলাকায় থাকতে পারছেন না। অনেকেই মাসের পর মাস পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

গত ২৩ জানুয়ারি সমকালের সংবাদ শিরোনাম 'বিএনপি নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর ফেরারি জীবনে'। খবরে বলা হয়, দলটির তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে হাইকমান্ড পর্যন্ত প্রায় সবার বিরুদ্ধেই মামলার পাহাড়। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি সাজার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। নিয়মিত মামলার সঙ্গে এখন সাজার দণ্ড মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবন পার করছেন তারা। কবে নাগাদ আত্মসমর্পণ করে জামিন নেবেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। কবে আবার মুক্ত জীবনে স্বাভাবিক নিয়মে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন, তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন, তাও কেউ জানেন না।

এখানেও মামলার শিকার নেতাকর্মীদের অভিযোগ কিংবা অনুযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেই। এই ইস্যুতে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগও নতুন কিছু নয়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ মৃত ব্যক্তিদেরও মামলার আসামি করা।

গত বছরের ৬ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনেরই একটি খবরের শিরোনাম ছিল 'মৃত ব্যক্তিকে দৌড়ে পালাতে দেখেছে পুলিশ'। একটি মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাতে গাজীপুরে পুলিশের একটি টহল দলকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমিন উদ্দিন মোল্লাসহ আরও ২১ জনকে দেখতে পান কাপাসিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সালাউদ্দিন। অথচ আমিন উদ্দিন ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি কবর থেকে উঠে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুঁড়লেন কি না—এই প্রশ্নও তখন উঠেছে। যদিও এই ধরনের মামলা এটিই প্রথম নয়।

এরকম বাস্তবতায় গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের 'শান্তি ও গণতন্ত্র' শীর্ষক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে 'অপ, সাম্প্রদায়িক শক্তি' হিসেবে মন্তব্য করে বলেছেন, 'এদের আমরা আর বাড়তে দিতে পারি না, রুখতে হবে।'

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা তাদের বক্তৃতায় বিএনপিকে 'সন্ত্রাসী দল' ঘোষণা করে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধেরও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সরকার তথা ক্ষমতাসীন দল কি সেদিকেই এগোচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন বা তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিলে সেটি কার জন্য মঙ্গলজনক হবে?

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন এতই ব্যাপক ও বিস্তৃত যে, চাইলেই এ দুটি দলকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে আওয়ামী লীগ কার্যত তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নামও সেভাবে উচ্চারণ করা যায়নি। কিন্তু মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগকেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলকে আইন করে নিষিদ্ধ করা যে খুব সহজ নয় তার উদাহরণ জামায়াতে ইসলামী। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে এই দলটির শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলেও এবং বিভিন্ন সময়ে এই দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হলেও জামায়াতে ইসলামী এখনও রাজনীতিতে সক্রিয়। সুতরাং বিএনপিকে হয়তো সরকার শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করবে না বা করতে পারবে না। কিন্তু এও ঠিক যে, সরকার চাইলে যেকোনো কিছুই করতে পারে। প্রশ্ন হলো, তাতে সমাধান কী? সেটি কি দেশের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে?

বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের প্রধান অভিযোগ ধ্বংসাত্মক রাজনীতি। বিএনপিরও এই একই অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তার মানে যখনই যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই তাদের প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।

প্রশ্ন হলো, প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন না করেও কি রাজনীতি করা যায় না? দেশ চালানো যায় না? সব দল ও মতকে সঙ্গে নিয়ে কি রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়? নাকি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং এরপরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করেছে, সেই দূরত্ব ঘুচবার নয়?

যদি তাই হয়, তাহলে কি দেশের প্রধান দুটি দল ও পক্ষের মধ্যে এই শত্রুতা চলতেই থাকবে? যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা তাদের প্রতিপক্ষ দমনে হামলা চালাবে, নানাভাবে তাদের প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে? এভাবে একটি দেশ কি এগোতে পারে?

রাজনীতিতে সংঘাত, সহিংসতা নতুন কিছু নয়। সহিংসতার ঘটনা ঘটলে মামলা হবে, সেই মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হবে এবং বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইনে আদালত তাকে শাস্তি দেবেন—এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি ঘটনা ঘটলেই যদি এমন সব মামলা হতে থাকে যার অভিযোগ অবিশ্বাস্য; এমনকি পুলিশ যখন মৃত ব্যক্তিদেরও মামলার আসামি করে; পুলিশের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ মামলায় যখন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেও উচ্চ আদালতে গিয়ে জামিন নিতে হয়—তখন সত্য অভিযোগও অবিশ্বাস্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তাদের ওপর মানুষের আস্থা কমতে কমতে তলানিতে নেমে যায়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরস্থায়ী অথবা ক্রমবর্ধিষ্ণু দূরত্বের খেলায় শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই নন, জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া যে বাহিনীর প্রধান কাজ— এক অর্থে তারাও ভিকটিম হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো একটি বাহিনীকে যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়, তখন সেই বাহিনী যদি আরও অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের জন্যও কঠিন।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments