রাজনীতিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি না থাকলে কার লাভ
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, 'তারা রাষ্ট্রের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু। অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের শত্রু।'
গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, 'বঙ্গবন্ধু এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আপনিই এটা পারবেন। বিএনপি, জামায়াত—স্বাধীনতাবিরোধীদের নিষিদ্ধ করলে বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।' বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নয় বলেও মন্তব্য করেন শেখ সেলিম। (প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)
এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সংসদে দেওয়া বক্তব্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করার দাবি জানান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
যদিও ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেছে। তবে তাদের নিষিদ্ধ করার চিন্তা এখনো দলগতভাবে আওয়ামী লীগ করেনি। এখানে আদালতের বিষয় আছে। আইন-আদালত তো মানতে হবে।'
ওবায়দুল কাদের যেদিন এই কথা বললেন, সেদিনই কারামুক্ত হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্টে নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিয়ে বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছিল যুবলীগ। তাছাড়া, বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই বলে একাধিকবার মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে বরিশালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, 'বিএনপি হচ্ছে একটি সন্ত্রাসী দল। এই সন্ত্রাসী দলের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। কারণ, তারা মানুষ পোড়ায়, মানুষ হত্যা করে।' (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩)
এসব কারণে রাজনৈতিক মহলে এরকম গুঞ্জন আছে যে, বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করা হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে সে পথে যাবে না, সেটি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে স্পষ্ট।
বিএনপি এবার নির্বাচনে না এসে ভুল করেছে; তারা নির্বাচনে এলে এই এই হতো; এখন দলের স্বার্থে তাদের করণীয় হচ্ছে এই—এরকম নানাবিধ মতামত ও পরামর্শ আসছে ভোটের পর থেকেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এইসব মতামত ও পরামর্শ আদৌ আমলে নেয় কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তবে আমলে নিক বা না নিক, যেহেতু বিএনপির বিরাট জনসমর্থন ও ভোটব্যাংক রয়েছে, ফলে তারা 'কী করিলে কী হইতো' জাতীয় মতামত দেওয়ার অধিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের যেমন রয়েছে, তেমনি বিএনপির শরিক কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোরও রয়েছে।
তবে এটা ঠিক যে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির কোনো লাভ না হলেও মোটা দাগে রাজনৈতিকভাবে তাদের হয়তো কোনো ক্ষতিও হয়নি। দলের সিনিয়র নেতাদের বিরাট অংশ কারাবন্দি থাকায় এটি তাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলের স্থানীয় পর্যায়ের অসংখ্য নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত হয়ে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত। এসব কারণে বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি হয়তো বাড়ছে অথবা সাধারণ ভোটারদের অনেকেই মনে করছেন যে বিএনপির সঙ্গে সরকার অন্যায় আচরণ করছে।
তার মানে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির যে সমর্থন ছিল, সেটি এই নির্বাচন বর্জনের ফলে হয়তো কমেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা এবং আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটানো খুব কঠিন। অতএব আগামী দিনে বিএনপির কী ধরনের রাজনীতি করা উচিত—সে বিষয়ে অনেকে নানারকম বুদ্ধিপরামর্শ দিলেও বিএনপির নিজস্ব একটা হিসাব নিশ্চয়ই আছে।
২০০৬ থেকে টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং নানাবিধ চাপের মধ্যে থেকেও যে দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, সেটিই বিএনপির শক্তি। কিন্তু এটিও ঠিক যে বিএনপির অন্যতম প্রধান সংকট যে দলের নেতৃত্ব—তাদের সেই উপলব্ধিটাও জরুরি।
এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় পার্টি। কেননা, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি হয়তো গোটা তিরিশেক আসন নিশ্চিত করতো। কিন্তু বিএনপি না আসায় জাতীয় পার্টিকে সমঝোতার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ দৃশ্যত ২৬টি আসন ছেড়ে দিলেও এর অধিকাংশই আনচ্যালেঞ্জড ছিল না। অর্থাৎ জাতীয় পার্টির প্রার্থীদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মোড়কে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। আর এই পরাজয়ের ফলে দলের ভেতরে কোন্দল আরও বেড়েছে—যা দলকে অধিকতর দুর্বল করছে।
ভোটে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের জয়ী হলেও ফলাফল প্রকাশের পরে ভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি নিজেও প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগ তাদেরকে 'কোরবানি' দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন। আর দলের পরাজিত প্রার্থীরা দুষছেন জি এম কাদেরকে।
এরকম বাস্তবতায় দলের দুজন শীর্ষ নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ ও সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে জি এম কাদেরের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছেন দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা। সবশেষ গত ২৫ জানুয়ারি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে একসঙ্গে গণপদত্যাগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী।
অতএব দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পরে দলীয় প্রধানের পদ নিয়ে দেবর-ভাবির মধ্যে টানাপড়েনের ধারাবাহিকতায় দলের ভেতরে যে কোন্দল বেড়েই চলছিল, সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল। এমতাবস্থায় জাতীয় পার্টি আরও এক বা একাধিক খণ্ডে ভাগ হয়ে যাবে কি না, সেটি এখনই বলা মুশকিল।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আরও বেশি প্রান্তিক বা মাইনাস হয়ে গেলে কার লাভ? এ কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না যে, কোনো একটি দেশে একটি দলের এককভাবে এমন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা উচিত নয় যাতে কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে ওই দলের পক্ষে বেপরোয়া তথা গণবিরোধী হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়—যা নানাভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সে কারণে একদলীয় বা কর্তৃত্ববাদী শাসন কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। তাতে সেই দেশে যতই দৃশ্যমান উন্নয়ন হোক না কেন।
মানুষ যতই প্রাচুর্যের ভেতরে থাকুক না কেন, দিন শেষে সে প্রাণ খুলে কথা বলতে চায়। নিজের মতামত ব্যক্ত করতে চায়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের অবস্থান জানাতে চায় এবং সেখানে প্রয়োজনে ভিন্নমত পোষণ করতে চায়। এটাই গণতন্ত্র।
অর্থাৎ রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে গণতন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে যত কথাই থাকুক না কেন, গণতন্ত্র মানে যদি হয় শাসন প্রক্রিয়ার সর্বত্র জনগণের অংশগ্রহণ, তাহলে সাধারণ মানুষ তার বিলাসিতা আর প্রাচুর্যের মধ্যেও ওই অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা চায়। সংবিধান যে তাকে সব ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই মালিকানার প্রয়োগ ঘটাতে চায় অন্তত ভোটের মধ্য দিয়ে হলেও। কিন্তু ভোটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে সে ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহে বোধ করে না।
দেশে যতই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হোক না কেন, একদলীয় বা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা যাতে গড়ে না ওঠে সেজন্য একটি বহুদলীয় এবং সহনশীল রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এবারের নির্বাচনে কার্যত জাতীয় পার্টিও একটি প্রান্তিক দলে পরিণত হয়েছে।
কোনো একটি দল এককভাবে তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সংসদ গঠন করবে, এমনকি স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ীরাও তাদের দলের, সেটি সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো উদাহরণ নয়। সংসদে ও সরকারে ক্ষমতার ভারসাম্য খুবই জরুরি। সেই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যই বিএনপি জাতীয় পার্টিসহ অন্য সব দলের সক্রিয় থাকা তথা সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার।
মনে রাখা দরকার, কোনো একটি দল এককভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাবান হয়ে গেলে এবং দেশে কার্যত একদলীয় বা কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটতে পারে। কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী হতে পারে। সে কারণে তুলনামূলক সহনশীল বা চরমপন্থি নয়—এমন দলগুলোর ভেতরে ঐক্য থাকা তথা শক্তিশালী হওয়াটা জরুরি।
ক্ষমতায় থাকার জন্য সব বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া বা প্রান্তিক করে দেওয়ার বদলে এমন একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার, যেখানে সরকার তার কাজের ব্যাপারে বিরোধীদের তরফে সমালোচনা শুনতে পারে।
তোষামোদী আর ভয়জনিত প্রশংসার বাইরেও সরকারের উচিত তার বিরোধীদের জন্য কথা বলার স্পেস তৈরি করা। কথা বলার স্পেস না থাকলে যে দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হবে, সেটি একসময় বুমেরাং হতে বাধ্য। এই ধরনের পরিবেশে ভেতরে ভেতরে এমন সব গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, যা মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কঠিন।
অতএব বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দলগুলোকে প্রান্তিক করে দেওয়ার চেষ্টা না করে আওয়ামী লীগের নিজের স্বার্থেই এমন একটি সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার যাতে কোনো উগ্রপন্থি দল শক্তিশালী হয়ে একসময় আওয়ামী লীগকেই চ্যালেঞ্জ করে বসতে না পারে। আওয়ামী লীগের মনে রাখা উচিত, যেকোনো চরমপন্থি দলের চেয়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তার জন্য অনেক বেশি নিরাপদ।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments