প্রধানমন্ত্রী কখন ‘গণধোলাইয়ের’ কথা বলেন?

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদেরও যেসব যুক্তি আছে, সেগুলোও আমলে নেওয়া জরুরি।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও যে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, সেটি তার বক্তব্যে স্পষ্ট। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'যারা কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় তাদের গণধোলাই দেওয়া উচিত।' দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা জড়িত থাকতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। (বিবিসি বাংলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী গণধোলাইয়ের কথা বলেন, সেটি সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন হলো, তিনি কি 'গণধোলাই' শব্দটি প্রতীকী অর্থে বলেছেন, নাকি আক্ষরিক অর্থে? প্রতীকী অর্থে বললেও বাজারে, ব্যবসায়ীদের মনে এবং ক্রেতার মনোজগতে এর কী প্রভাব পড়বে? বাজারের এই পরিস্থিতির জন্য দায় কার? সরকার নিজে কি এর দায় এড়াতে পারে? সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে?

প্রধানমন্ত্রী যেদিন এই কথা বলেছেন, তার পরদিনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মন্ত্রী বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'বিএনপি সিন্ডিকেট লালন-পালন করছে, মজুদদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে—এ কথা বললে কি ভুল হবে?' তিনি বলেন, 'বিএনপি সরকার ছিল ব্যবসায়ী সরকার। আওয়ামী লীগ ব্যবসা করতে আসেনি। এখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে—এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। যে অশুভ চক্র দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জন অসন্তোষের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই জোরালোভাবে সেটি বলেছেন।'

এদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অনেকটা একইরকম মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। প্রসঙ্গত, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তথা বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বিএনপির ষড়যন্ত্রের এই অভিযোগ ক্ষমতাসীনদের তরফে আগেও এসেছে।

প্রশ্ন হলো, যে দলটি টানা ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, সেই দলটি কি আসলেই বাজার অস্থিতিশীল করার মতো শক্তি রাখে? যে দলটির নেতারা নিজেরাই শত শত মামলায় বিপর্যস্ত এবং জীবনের একটা বড় সময় যাদের কাটে আদালতের বারান্দায়; যাদের নিজেদের অস্তিত্বই এখন সংকটে; যাদের দলের অভ্যন্তরেই নানা সমস্যা ও নেতৃত্বের কোন্দল—তাদের কথায় ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেবেন কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করবেন—সেটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যবসায়ীরা কি বিএনপির কথায় চলে বা ব্যবসায়ীদের ওপর বিএনপির এই নিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো? কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করতে পারেন—এমন ব্যবসায়ীদের সবাই কি সরকারবিরোধী বা সবাই কি বিএনপিপন্থি?

গত ১৫-১৬ বছরে ব্যবসায়ীসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি খাতে সরকারের যে অভাবনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এতদিন পরেও ব্যবসায়ীদের ওপর বিএনপির এতটা প্রভাব কী করে থাকে? তাছাড়া গত ১৫-১৬ বছরে রাষ্ট্রের যেসব গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছে বা নানাভাবে লাভবান হয়েছে, তাদের মধ্যে ব্যবসায়ীরা যে শীর্ষে, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণের সুযোগ কম। সুতরাং সেই ব্যবসায়ীরা কেন, কোন স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে যাবেন বা এমন কিছু করবেন যাতে সরকার বিব্রত হয়? আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে ব্যবসায়ীদের কি আরও বেশি লাভ হবে? চট করে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।

তবে এটা ঠিক যে, ব্যবসায়ীরা সব সময়ই সুযোগসন্ধানী। যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য মুনাফা। রাষ্ট্রের যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের ব্যবসা ঠিক রাখতে চান। ডলারের দাম বেড়ে গেলে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। তাতে আখেরে তাদের কোনো লস না হলেও বাজারমূল্যের বাড়তি দামের ভিকটিম হতে হয় সাধারণ ক্রেতাকে। আবার দেশের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে কিংবা খারাপ পরিস্থিতি ধুয়ো তুলে মুহূর্তের মধ্যে শত বা হাজার কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা তুলে নিতেও ব্যবসায়ীরা ওস্তাদ। এর অসংখ্য উদাহরণ আছে।

প্রশ্ন হলো, এসব দেখার দায়িত্ব কার? ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা এবং সরকারের একাধিক গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে সক্রিয়। তারপরেও ব্যবসায়ীদের কী করে সিন্ডিকেট করে বা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করতে পারেন? তাহলে কি সরকারের এইসব প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হচ্ছে নাকি তাদের লোকবল ও বাজেটের সংকট?

যদি বিএনপির কথায় ব্যবসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন বা বিএনপির লোকেরা যদি বাজারে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন, তাহলে সরকারের বাহিনীগুলোর কাছে তার তথ্যপ্রমাণ থাকার কথা। সেক্ষেত্রে এইসব নেতা ও ব্যবসায়ীদের সরকার কেন গ্রেপ্তার করছে না এবং গ্রেপ্তার করে সরকার কেন তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরছে না?

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের অনুভূতি বা পালস যে প্রধানমন্ত্রী বোঝেন, সেটির প্রমাণ তার বক্তব্য। তিনি চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এড়িয়ে যাননি। বরং তিনি যে কথা বলেছেন, সেখানে ক্ষোভ আছে, হতাশাও আছে। তিনি নিজেকে একজন সাধারণ ক্রেতার কাতারে নামিয়েই বিষয়টি ভেবেছেন।

রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে প্রকৃত পরিস্থিতি অস্বীকার করার যে প্রবণতা দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে অন্তত নিত্যপণ্যের বাজার ইস্যুতে সেটি দৃশ্যমান নয়। তিনি বরং পরিস্থিতির স্বীকার করছেন এবং মানুষকে সতর্ক করছেন। তার এই সতর্ক করার মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ব্যবসায়ীদের সতর্ক করছেন। তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে যদি সত্যিই কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে এর পরিণতি ভালো হবে না।

এখানে তিনি 'গণধোলাই' শব্দটি সম্ভবত প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। তবে অতি উৎসাহী কেউ যাতে ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা দলীয় আদর্শের কারণে সত্যিই গণধোলাই শুরু না করে, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। কেননা সেরকম ঘটনা শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে—যা কাঙ্ক্ষিত নয়।

ব্যবসায়ীদেরও বুঝতে হবে, শুধু মুনাফা করাই তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান নয়। মানুষকে সেবা দিতে হবে। দেশটা যেমন তাদের, তেমনি সাধারণ মানুষেরও। ক্রেতা না থাকলে বিক্রেতার কোনো দাম নেই। আবার প্রত্যেক বিক্রেতাও দিন শেষে ক্রেতা। তিনি যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যান, তাহলে তাকেও কোনো না কোনোভাবে তার ভিকটিম হতে হবে।

সুতরাং একটি রাষ্ট্র শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের দিয়ে যেমন চলে না, তেমনি শুধু রাজনীতিবিদদের দিয়েও চলে না। শুধু জনগণ দিয়েও দেশ চলে না। সবাইকে নিয়েই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সবার জন্য। এখানে ব্যবসায়ীরা যদি ক্রেতাদের এবং রাজনীতিবিদদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, তাহলে দিন শেষে তাদের ব্যবসাটা থাকবে না।

তবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদেরও যেসব যুক্তি আছে, সেগুলোও আমলে নেওয়া জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেল সংকট, কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে যদি পণ্যের দাম বেড়ে যায়—সেখানে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজির মূল অভিযোগ পুলিশ এবং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সুতরাং এই চাঁদাবাজি বন্ধে প্রথমত এবং প্রধানত দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

সরকার বা ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে যে, রাস্তাঘাট ও হাটবাজারে চাঁদাবাজির অবাধ সুযোগ দিয়ে বিরাট সংখ্যক দলীয় নেতাকর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলো, তাহলে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। যারা দলকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন, তৃণমূলে দল সংগঠিত রাখতে সময় ও শ্রম দেন, তাদের কর্মসংস্থান তথা উপার্জনের জন্য চাঁদাবাজির বাইরে অন্য কোনো সম্মানজনক উপায় খুঁজতে হবে। আবার এসব চাঁদাবাজির বিরাট অংশ যেহেতু বড় বড় নেতাদের কাছেও চলে যায়, ফলে তাদেরকে চিহ্নিত করাও জরুরি। সেটি চিহ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। অর্থাৎ সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে এলে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা গেলে 'গণধোলাইয়ের' প্রয়োজন হবে না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments