মিয়ানমারের চেয়েও বাংলাদেশের মানুষ বেশি অসুখী?
'সুখ তুমি কী বড় জানতে ইচ্ছে করে'—প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার একটি জনপ্রিয় গান। সুখ আসলে কী? সুখের কি সংজ্ঞা হয়? কে কখন সুখী হয়? সুখের মানদণ্ড কী? অসুখ না থাকা মানেই কি সুখী? একজন মানুষের কোনো অসুখ নেই বা রোগশোক নেই, তার মানে কি তিনি সুখী? নাকি সুখী হতে শারীরিক সুস্থতার বাইরেও জীবনযাপনের আরও অনেক কিছুর নিশ্চয়তার প্রয়োজন?
ফুটপাতে কিংবা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মানুষের কোলাহল আর যানবাহনের শব্দের ভেতরেই পণ্য আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত সাঁজির মধ্যে গুটিসুটি মেরে যে শ্রমিক ঘুমিয়ে থাকেন এবং সেই ছবি যখন গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, তখন অনেকেই বলেন: 'আহা কী শান্তির ঘুম!'
এই শ্রমিকরা কি সুখী? সুখ না থাকলে কি শান্তিতে ঘুমানো যায়? সুখ ও শান্তি কি আলাদা বিষয়? এ দুটির মধ্যে সম্পর্ক কী?
এসব প্রশ্নের কোনো একক উত্তর নেই। এর উত্তর একেকজনের কাছে একেকরকম। একেকজনের কাছে সুখ একেকভাবে হাজির হয়।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের জনপরিসরে এই কথা চালু আছে যে, বাংলাদেশের মানুষ খুবই সুখী। কারণ, তারা অল্পতেই তুষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এ বছরের 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট' বা সুখের বৈশ্বিক সূচক বলছে, সুখী দেশের তালিকায় উন্নত দেশগুলো তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ যেমন: ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কারও পেছনে বাংলাদেশ। এমনকি সামরিক সরকার পরিচালিত মিয়ানমারেরও পেছনে।
এটা কী করে সম্ভব? যদি এই প্রতিবেদন সঠিক হয়, তাহলে এই প্রশ্ন তুলতে হবে যে, বাংলাদেশের মানুষ কেন সুখে নেই কিংবা তাদের সুখী হওয়ার বা সুখে থাকার উপাদানগুলো কি কমে যাচ্ছে? তারা কি এখন আর অল্পে তুষ্ট থাকতে পারছে না? তারা কি অনেক বেশি ভোগবাদী হয়ে উঠছে?
অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে এখন আর মধ্যবিত্ত বলে কোনো শ্রেণি নেই। আছে উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত হওয়ার জন্য নানারকম অন্যায় অপকর্মে যুক্ত একটি বিরাট শ্রেণি—যারা নিজেদেরকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বলে দাবি করলেও অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাষায় যাদেরকে মধ্যবিত্ত বলা হয়, তারা সেই কাতারে পড়েন না। এর বাইরে বিরাট জনগোষ্ঠী এখন খরচের চাপে মূলত নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক লোকই এখন আসলে গরিব, দরিদ্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, দেশের ২৬ শতাংশ অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষই এ জন্য বেশি ঋণ করছে। শহর ও গ্রামের মানুষ এ ঋণের বড় অংশই নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে, চড়া সুদে। (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ ২০২৪)
যদিও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, তাদের বিভিন্ন জরিপে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে বিবিএসের তথ্যের চেয়েও বেশি সংখ্যক পরিবার এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এসব পরিবারের পক্ষে ঋণ করে টিকে থাকাও ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছে।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে নিত্যপণ্য, বাসাভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ প্রতিটি খাতেই জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। এ কারণে নিম্নআয়ের মানুষের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ কমে গেছে। গত ২২ মার্চ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি মসজিদে জুমার নামাজের আলোচনায় খতিব জানান, জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তার মসজিদে এবার ইফতারি করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত বছরও যেখানে দৈনিক ৪০০ মানুষের জন্য ইফতারির আয়োজন করা হয়েছে, এবার সেখানে দৈনিক আয়োজন করতে হচ্ছে ৭০০ জনের ইফতারি। যেখানে প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকা। মসজিদের মুসল্লিরাই এই টাকার জোগান দিচ্ছেন।
সুখের সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে গেলে মানুষের মনে অস্থিরতা ও উদ্বেগ বাড়ে। যা তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে। তার ঘুম কেড়ে নেয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ঋণগ্রস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব নয়। ফলে যখন দেশের অর্থনীতি চাপে থাকে, তখন সেই দেশে সুখী মানুষের সংখ্যা কমবে, সেটি অস্বাভাবিক নয়।
প্রশ্ন হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবকাঠামো খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং যেগুলোকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যেমন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। কিন্তু তার বিপরীতে তিনবেলা পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং জীবনযাপনের অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে সুখে ও স্বস্তিতে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে?
যদি না বাড়ে তাহলে এই প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত যে উন্নয়ন হচ্ছে কার জন্য, কত শতাংশ মানুষের জন্য? হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে কী লাভ, যদি শতভাগ মানুষের অন্তত তিনবেলা মানস্মত খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা না থাকে?
এবারের হ্যাপিনেস ইনডেক্স বা সুখের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩ দেশের মধ্যে ১২৯তম। গত বছরের চেয়ে এবার ১১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, এবার মিয়ানমারেরও পেছনে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান শুধু আফগানিস্তানের উপরে।
প্রসঙ্গত, সুখী দেশের এই তালিকা তৈরির জন্য পরিচালিত এই জরিপে একজন মানুষের নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্টির মাত্রা (তার নিজের বিবেচনা অনুযায়ী), মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক সুরক্ষা ও সহায়তা পরিস্থিতি, স্বাধীনতা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, গড় আয়ু ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেইসব বিবেচনায় বাংলাদেশ এবার কী করে মিয়ানমারেরও পেছনে পড়ে গেলো, সেটি ভাবনার বিষয় এবং এটি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।
বৈশ্বিক সুখের সূচকে বরাবরের মতো এবারও বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড শীর্ষে। তার প্রতিবেশী ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়ে—এসব দেশও সুখী দেশগুলোর তালিকার উপরেই অবস্থান করে।
প্রশ্ন হলো, এইসব দেশের মানুষ কেন সুখী? কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে:
১. তাদের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী।
২. তাদের সরকারগুলো জনবান্ধব।
৩. তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনাগুলো তৈরি করা হয় জনঅংশগ্রহণে।
৪. এই দেশগুলো দুর্নীতিমুক্ত।
৫. এসব দেশের সামাজিক সুরক্ষা অনেক বেশি শক্তিশালী।
৬. এসব দেশের জনগণকে রাষ্ট্রীয় সেবাদানের বিনিময়ে গণকর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয় না।
৭. এসব দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা হরিলুট হয় না।
৮. এসব দেশের মানুষেরা সহনশীল।
৯. রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে তাদের জীবন বিপন্ন করা হয় না।
১০. এসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকতে এবং ক্ষমতায় যেতে জনগণের শক্তিকে অস্বীকার করে প্রশাসনিক শক্তিতে ভরসা রাখে না।
আরও একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে এই কারণগুলো সামগ্রিকভাবে জনজীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে—যা তাদের সুখী হওয়ার ব্যাপারটিকে হয়তো সহজ করে।
বলা হয় সুখ এমন একটি অনুভূতি, যা ব্যক্তি নিজে অনুভব না করলে জোর করে কাউকে সুখী বানানো সম্ভব নয়। খুব অর্থকষ্টে থাকা একজন মানুষও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিজেকে সুখী ভাবতে পারেন। পক্ষান্তরে খুব প্রাচুর্যর মধ্যে থেকেও একজন মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে অসুখী হতে পারেন বা অসুখী বোধ করতে পারেন।
কিন্তু রাষ্ট্রে যখন স্থিতিশীলতা থাকে, সামগ্রিকভাবে দেশে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন থাকে, নাগরিকদেরকে যদি সেবা নিতে গিয়ে কোনো ধরনের হয়রানি বা অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়, মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়েও যদি তাদেরকে উদ্বিগ্ন হতে না হয়, তাহলে তাদের পক্ষে নিজেকে সুখী মনে করাটা সহজ হয়।
জাতিসংঘ মনে করে, 'যেসব দেশে সমৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য আছে, অর্থাৎ যেসব দেশে সমাজের চূড়ান্ত পর্যায়ের আস্থা আছে, অসমতা কম ও সরকারের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা আছে—সেসব দেশ সাধারণ মাপকাঠিতে সুখী দেশ।' আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্যই যে প্রধান সমস্যা, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কারো দ্বিমত নেই। এখানে একটি শ্রেণি অবৈধ উপায়ে টাকা কামিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যাচ্ছে—যারা নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ করছে। তাছাড়া এই ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষের মধ্যে বঞ্চনাবোধ তৈরি করে। একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠী কখনো নিজেকে সুখী ভাবতে পারে না।
সর্বোপরি প্রতিটি মানুষের সুখী হওয়ার তরিকা ভিন্ন হলেও আমরা যখন কোনো একটি রাষ্ট্রের মানুষের সামগ্রিক সুখের গড় বা হ্যাপিনেসের জেনারেল ট্রেন্ড নিয়ে কথা বলি, তখন সেখানে সেই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানুষের সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও বিশ্বাস কেমন—সেগুলোও বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা একজন ব্যক্তির সুখী হওয়ার পেছনে তার পারিপার্শ্বিকতা, তার সমাজ, তার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনা বিরাট ভূমিকা পালন করে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments