হাওরে আলপনার পক্ষ-বিপক্ষ
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় হাওরের বুক চিরে নির্মিত বহুল আলোচিত ও সমালোচিত অলওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়কে দৃষ্টিনন্দন আলপনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
বাংলা বর্ষবরণের অংশ হিসেবে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম এই আলপনা আঁকা হয়েছে। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড এই উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে আলপনাটি আঁকা হলেও এই কার্যক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনও যুক্ত৷
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আলপনাটি জায়গা করে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, হাওরের বুক চিরে রাস্তাটি নির্মাণের শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করেছিলেন৷ তাদের যুক্তি ছিল, এই ধরনের সড়ক হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এটি এখন ওপেন সিক্রেট যে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত 'স্বপ্ন' বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার এই সড়কটি নির্মাণ করে এবং এর বিরুদ্ধে যাতে কোনো শক্ত আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়।
আশার কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই সড়কের কুফল বুঝতে পারছেন এবং ভবিষ্যতে হাওরের বুকে এরকম সড়ক নির্মাণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বহুল আলোচিত এই সড়কটি নতুন করে আলোচনায় এলো বর্ষবরণের আলপনা ইস্যুতে।
প্রশ্ন হলো, হাওরের বুক চিরে গড়ে তোলা একটি পরিবেশবৈরি সড়কে কেন দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকতে হলো? এর উদ্দেশ্য কি মানুষের মনকে নববর্ষের রঙে রাঙিয়ে তোলা, নাকি আয়োজকদের ব্র্যান্ডিং—সেটি বোঝার জন্য বড় কোনো জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই আলপনা আঁকতে কত গ্যালন রঙ ব্যবহার করা হলো? কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষমাত্রই জানেন এই রঙের চূড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে হাওরের পানি।
গ্রীষ্মের তাপে রঙ ফিকে হয়ে আসবে। সেজন্য সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যে বৃষ্টি হলেই এই রঙ ধুয়ে যাবে এবং হাওরের বিশুদ্ধ পানিতে মিশে যাবে। মাছ সেই রঙ খাবে মাছ। মাছ খাবে মানুষ। পানির সিঁড়ি বেয়ে এই রঙ মিশে যাবে আশেপাশের মাটিতে। ফলে কেমিক্যালমিশ্রিত এই রঙ ফসলি জমির কী পরিমাণ ক্ষতি করবে সেটি পরিবেশবিদরা ভালো বলতে পারবেন।
অলওয়েদার রোডের এই আলপনার ছবি দিয়ে এরইমধ্যে পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
পরিবেশ, জলবায়ু ও বায়ুমান নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, 'হাওরের রাস্তায় এই রঙের খেলায় নববর্ষ উদযাপন আসলে প্রকৃতি হত্যার উৎসব ছাড়া কিছু নয়। এই বিশাল পরিমাণ রঙে আছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল যেমন বেনজেন, টলিউন ইত্যাদি। আছে ভারী ধাতু যেমন ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি, যা দ্রুত হাওরের প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবেশবিধ্বংসী এই ধরনের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।'
গিনেজ বুকে নাম ওঠানোর জন্য লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়নি। বরং দলমত নির্বিশেষে সবাই এর প্রশংসা করেছেন।
এমনকি প্রতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিশাল এলাকাজুড়ে যে আলপনা আঁকা হয়, তা নিয়েও কোনো সমালোচনা নেই। কারণ এখানে ব্যবহৃত রঙ নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে গিয়ে পড়ে না। বরং রৌদ্রের তাপ, বৃষ্টি ও যানবাহনের চাকার ঘষায় রঙ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।
কিন্তু মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আলপনা আর হাওরের বুক চিরে বানানো রাস্তার ১৪ কিলোমিটারজুড়ে আঁকা আলপনা এক নয়। একই জিনিস ঢাকার রাস্তায় যতটা সুন্দর, পরিবেশের জন্য স্পর্শকাতর হাওরের রাস্তায় সেটি সুন্দর নয়, বরং চরম অসুন্দর ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরোধী চিন্তা। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাদাচোখে যা কিছু সুন্দর, বাস্তবে তার সবকিছু সুন্দর নাও হতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এই আলপনা নিয়ে সমালোচনার বিপরীতে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন এই বলে যে, দখল, দূষণ, কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে যেখানে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল বিপন্ন হচ্ছে, সেখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটারের আলপনায় হাওরের আর কতটুকুই বা ক্ষতি হবে?
যুক্তি হিসেবে এটি খারাপ না। কিন্তু ডাকাতি ঠেকানো যাচ্ছে না বলে চুরির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না—সেটিও কোনো কাজের কথা নয়।
তাছাড়া এরকম একটি বিতর্কিত সড়কে নববর্ষের আলপনা আঁকার মধ্য দিয়ে সড়কটিকে গ্লোরিফাই করার রাজনীতিটাও বোঝা দরকার। বাঙালির সর্বজনীন ও চিরায়ত উৎসবগুলো যাতে মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে না যায়, সেজন্য সতর্ক থাকা দরকার। এরইমধ্যে অনেক কিছুই আর আমাদের হাতে নেই। ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখী মেলা, হালখাতার মতো আয়োজনও কোনো না কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নামে হয়ে যাবে। আমাদের কাছ থেকে আমাদের নিজস্বতাগুলো কেড়ে নেওয়ার যেকোনো আয়োজন ও উৎসবের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
হাওরের মতো সংবেদনশীল স্থানে এরকম রঙের খেলার চিন্তাটা যার বা যাদের মাথা থেকেই আসুক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য যে নববর্ষের রঙে মানুষের মনকে রাঙানো নয়, সেটি বোঝা দরকার। সেইসঙ্গে হাওরের পানিকে কোনো ধরনের বাধা বিঘ্ন ছাড়া চলতে দেওয়া এবং সেখানে মৎস্যসম্পদ ও কৃষির সুরক্ষায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ না করাই যে প্রকৃত উন্নয়ন, সেই উপলব্ধিটাও জরুরি।
সুতরাং, নববর্ষের আলপনা ইস্যুতে হাওরের অলওয়েদার সড়কটি যেহেতু নতুন করে আলোচনায় এলো, অতএব এই রাস্তা হাওরের মানুষের কী কাজে লাগছে আর এই রাস্তা হওয়ার ফলে হাওরের কৃষি, মৎস্য সম্পদ আর মানুষের জীবন-জীবিকার কী উপকার হলো এবং কী ক্ষতি হলো—সেটি নিরূপণ করাও জরুরি।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments