এত জমির মালিক হতে সংবিধান ও আইন কেন বেনজীরকে বাধা দিলো না?

টাকা থাকলেই ইচ্ছেমতো জমি কেনা যায় বলেই দেশে ভূমিদস্যুদের জন্ম হয়েছে।

একাই ৪৬৮ বিঘা জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী; দেশজুড়ে তার জমিদারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার নানা খবরের ভিড়ে এই খবরটি একটু অন্যরকম—যেখানে বলা হয়েছে, বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জিসান মির্জার নামে আছে প্রায় ১৪২ একর (৪৬৮ বিঘা) জমি।

খবরে বলা হচ্ছে, বেনজীর আহমেদ নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন। বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের নামে এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ২০৫ একর সম্পদের মধ্যে ১৪২ একর রয়েছে স্ত্রীর নামে।

প্রশ্ন হলো, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কী পরিমাণ জমির মালিক হতে পারেন? টাকা থাকলেই একজন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছেমতো জমি কিনতে পারেন কি? যদি কেউ চান যে তিনি কোনো একটি জনপদের অর্ধেক কিনে নেবেন—রাষ্ট্র কি সেটি অনুমোদন করবে? বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন কী বলছে?

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর যে আলোচনা ও বিতর্ক হয়, সেখানেও এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল যে বাংলাদেশের একজন নাগরিক সর্বোচ্চ কতটুকু জমির মালিক হতে পারবেন? রাষ্ট্র একজন নাগরিকের সম্পদ অর্জনের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেবে কি না? বিশেষ করে সংবিধানের মূলনীতি 'সমাজতন্ত্র' কায়েম করতে গেলে দেশের সম্পদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেনসহ গণপরিষদ ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে আইন এবং সংসদীয় বিষয়াবলি ও সংবিধান প্রণয়ন-মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, 'সম্পত্তির অধিকার বা ব্যবসা ও বাণিজ্যের অধিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য ব্যবস্থার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এইজন্য আমরা বলেছি যে, আইন-সাপেক্ষে এই সব অধিকার ভোগ করা হবে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংসদ এইসব অধিকার হরণ করতে বা সীমাবদ্ধ করতে পারবেন। সংসদ যদি সে রকম কোনো আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে আদালত তা নাকচ করতে পারবেন না।' (গণপরিষদ বিতর্ক, মো. আব্দুল হালিম, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৭৫)।

পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবিধান বিলের ওপর ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর যে দীর্ঘ ভাষণ দেন, সেখানে তিনি বলেন, 'ব্যক্তিগত মালিকানা সম্বন্ধে বহু চিন্তা-ভাবনা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ সীমানির্ধারণ সম্ভব হয়নি—এমনকি, সোভিয়েট রাশিয়ার মতো দেশেও তা সম্ভব হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, কোন ব্যক্তির বাড়ি-ঘর, ভূমি ইত্যাদিতে তার বংশের উত্তরাধিকার থাকবে এবং উত্তরাধিকার-সূত্রে তা পাওয়ার যোগ্যতা থাকবে। কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা শাসিত দেশগুলিতেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমানির্ধারণ সম্ভব হয়নি, বরঞ্চ বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি লাভ করেছে।'

সৈয়দ নজরুল বলেন, 'কতখানি সীমার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নির্ধারণ এখন করে দেওয়া উচিত কি উচিত নয়, এ সম্বন্ধে এখানে প্রশ্ন উঠেছে। কাল গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনে যে সংকট দেখা দেবে, তার সঙ্গে আইনপরিষদ-সদস্যরাই তা নির্ধারণ করবেন। এখন তা নির্ধারণ করে দিলে হয়তো কালের পরিক্রমায় এটা outdated হয়ে যেতে পারে। তাই এটা এখানে উল্লেখ না করে ভবিষ্যত আইন-প্রণেতাদের কাছে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।' (গণপরিষদ বিতর্ক, পৃ. ১০৬)

এদিনের বৈঠকে কুমিল্লা-২ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আলী আজম বলেন, 'গণতান্ত্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়-মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানা সম্বন্ধে সংবিধানে এমন বিধান রাখা হয়েছে, যাতে ব্যক্তিগত মালিকানা অবাধ না হয়, তার জন্য আইনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করার ব্যবস্থা আছে। আইন-দ্বারা প্রতিটি বিষয় সীমাবদ্ধ করা যাবে। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা: গরীব যাতে আরও গরীব না হয়, ধনী যাতে আরও ধনী না হয়, আইনের মাধ্যমে সেটা এমনভাবে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যাবে, যাতে দেশের আপামর জনসাধারণের উপকার করা যায়।'

১৯৭২ সালের ২৪ অক্টোবরের বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল বলেন, 'আজ এখানে ব্যাংক বিমা জাতীয়করণ করা হয়েছে। পাট ব্যবসা, পাট শিল্প জাতীয়করণ করা হয়েছে। জমির উচ্চ সীমারেখা ধার্য করে দেওয়া হয়েছে। ভূমিহীন চাষীদের ভূমি দেওয়া হচ্ছে। একশো বিঘার উপরে কেউ জমি রাখতে পারবে না।'

পরদিন ২৫ অক্টোবরের বৈঠকে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আছাদুজ্জামান খান বলেন, 'অনেক জায়গা থেকে দাবী উঠেছে যে, সম্পত্তির সীমা-রেখা নির্ধারণ করে দেওয়া হোক, কিন্তু আমরা তা পারি না। কারণ, এতে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব খর্ব করা হবে। আমরা বলেছি, জনসাধারণের ভোটে আগামীতে যে পার্লামেন্ট আসবেন, তাঁরাই সেটা আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করবেন।'

তিনি আরও বলেন, 'যাঁরা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে চান, তাঁদেরকে বলব, সংবিধানের অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সেটা আসতে পারে। ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ের সুস্পষ্ট বিধান আছে। সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেওয়া চলবে।' (গণপরিষদ বিতর্ক, পৃ. ২৯২)

প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয় তার ৪২ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।'

কিন্তু এখানে উল্লেখ নেই যে, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ কী পরিমাণ জমির মালিকানা লাভ করতে পারবেন। অর্থাৎ গণপরিষদে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হলেও একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কী পরিমাণ সম্পদ বা জমির মালিক হতে পারবেন, তার সীমারেখা নির্ধারণ করা না হলেও রাষ্ট্র চাইলে যেকোনো সময় আইনি প্রক্রিয়ায় যে কারো জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিতে পারবে।

কিন্তু শুরু থেকেই বিতর্কটি ছিল যে সম্পদ, বিশেষ করে জমির মালিক হওয়ার একটি সীমারেখা ঠিক করে না দিলে স্বল্প আয়তনের দেশে কিছু লোক তাদের বৈধ-অবৈধ আয় দিয়ে ইচ্ছামতো জমির মালিক হতে পারবেন এবং সেটি একপর্যায়ে বড় ধরনের বিপদ তৈরি করবে। সেজন্য একটি আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের এবং গণপরিষদ সদস্যরাও বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

অবশেষে ২০২৩ সালে যে 'ভূমি সংস্কার আইন' প্রণয়ন করা হয়, সেখানে শর্তসাপেক্ষে জমির সর্বোচ্চ মালিকানার একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন: এই আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি একক নামে ৬০ বিঘার (১ বিঘা সমান ৩৩ শতাংশ) বেশি জমির মালিক হতে পারবেন না। কারও নামে ৬০ বিঘার বেশি জমি থাকলে অতিরিক্ত জমি সরকার অধিগ্রহণ করতে পারবে। আর এ জন্য সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না।

তবে আইনে কিছু ব্যতিক্রমের কথাও আছে। যেমন: সমবায় সমিতি; চা, কফি, রাবার ও ফলের বাগানমালিক; শিল্প কারখানার কাঁচামাল উৎপাদন হয়, এমন জমির মালিক; রপ্তানিমুখী শিল্প ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতের কাজে ব্যবহার হওয়া জমির মালিক; ওয়াকফ ও ধর্মীয় ট্রাস্টের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।

প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী যে ৪৬৮ বিঘা জমির মালিক হলেন, সেটি কি এই আইন অনুযায়ী বৈধ? যদি না হয় তাহলে রাষ্ট্র কি এই জমি খাস হিসেবে ঘোষণা করবে?

তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, এত বিপুল পরিমাণ জমি তিনি কীভাবে কিনলেন? তার সারা জীবনের অর্জিত অর্থ দিয়েও কি এই পরিমাণ জমি কেনা সম্ভব? তার মানে এগুলো যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থে কেনা এবং এর মধ্যে বিপুল জমি যে তিনি দখল করেছেন—সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

শুধু বেনজীর আহমেদ নন। বরং বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির মালিকদের জমির পরিমাণ নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে।

যেমন:

১. তারা বিদ্যমান আইনে এত বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হতে পারেন কি না;

২. এর মধ্যে কী পরিমাণ জমি তাদের কেনা এবং কী পরিমাণ দখল;

৩. যাদের কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে তারা প্রকৃত দাম পেয়েছেন কি না;

৪. সবাই কি স্বেচ্ছায় এসব জমি বিক্রি করেছেন নাকি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন;

৫. তারা যে এত বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হলেন সেই অর্থের উৎস কী;

৬. তারা চাইলেই যেখানে খুশি জমি কিনতে পারেন কি না ইত্যাদি।

সুতরাং, বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চললেও এখন তার মতো আরও যেসব লোক এরকম বিপুল সম্পদ, বিশেষ করে যাদের মালিকানায় বিঘার পর বিঘা জমি আছে—আইনত তারা সেসব জমির মালিক হতে পারেন কি না, সেটি যেমন খতিয়ে দেখা দরকার, তেমনি তাদের এইসব জমি কেনার টাকার উৎস কী—সেটিরও নির্মোহ অনুসন্ধান জরুরি। কেননা টাকা থাকলেই ইচ্ছেমতো জমি কেনা যায় বলেই দেশে ভূমিদস্যুদের জন্ম হয়েছে।

স্বল্প আয়তনের বাংলাদেশ যেখানে জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ; যেখানে নগরায়ন, শিল্পায়নসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই ফসলের জমি ও নিচু জমি কমছে—সেখানে ব্যক্তির সম্পদ, বিশেষ করে জমির মালিকানা অর্জনের সীমা ঠিক করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। না হলে ভবিষ্যতে পুরো দেশটি অথবা দেশের বিরাট অংশই কিছু লোকের মালিকানায় চলে যাবে এবং বাংলাদেশ তখন আর জনগণের রাষ্ট্র নয়, বরং ভূমিদস্যু ও টাকাওয়ালাদের দেশে পরিণত হবে—যেটি স্পষ্টতই সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments