আবেদ আলী কীভাবে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস করলেন?

তারা যাদের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেছেন তাদের কতজনের চাকরি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি এখন প্রশাসনের বড় পদে থাকেন, তাদের নামগুলোও কি জানা যাবে?

বিসিএস পরীক্ষায় কোনো দুর্নীতি হয় না, পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস হয় না, এই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাই নীতিবান—এরকম একটা পারসেপশন জনপরিসরে আছে শুরু থেকেই। মানুষ সেটা বিশ্বাসও করতো। হয়তো এই পারসেপশনের অনেকটা সঠিক।

কিন্তু ধরুন একটি বিরাট মাছ ধরার জালে ছোট্ট একটা ছিদ্রও যদি থাকে, তাহলে সেই ছিদ্র দিয়ে বড় মাছ বের হতে না পারলেও ছোট মাছগুলো ঠিকই বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং এই ছোট মাছগুলোই বড় হয়ে ছোট, মাঝারি এমনকি তার নিজের সাইজের মাছও খেয়ে ফেলতে চায়। অতএব, আবেদ আলীর কাছে জাতি অন্তত এই কারণে 'কৃতজ্ঞ' যে, তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসির যে শ্লাঘা এবং বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে যে প্রশ্নহীন সন্তুষ্টি ছিল—সেটি সত্য নয়। কেননা আবেদ আলী নিশ্চয়ই মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার কোনো প্রেসে প্রশ্ন ছেপে সেগুলো বিক্রি করতেন না। বরং পিএসসির প্রশ্ন যে গোপন প্রেসে ছাপা হয়, সেই প্রেসের কোনো লোক অথবা প্রশ্ন সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো লোক কিংবা লোকদের সহায়তা নিয়েই তিনি প্রশ্ন জোগাড় করতেন—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই।

অনেকে সৈয়দ আবেদ আলী পিএসসির যে চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ছিলেন তার দিকেও আঙুল তুলছেন যে, ড্রাইভার দুর্নীতি করে এত টাকা কামিয়েছেন, না জানি চেয়ারম্যান কী করেছেন! এই ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। কেননা ড্রাইভার কী করেন বা গোপনে তিনি যে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন, সেটি চেয়ারম্যানের নজরে নাও আসতে পারে। আবার চৌকস হলে তার গতিবিধিকে সন্দেহ করাও উচিত। সেই চেয়ারম্যান মহোদয় নিজের ড্রাইভারকে আদৌ সন্দেহ করতেন কি না কিংবা সন্দেহ করার মতো কোনো গতিবিধি তার ছিল কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু যতক্ষণ না প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ আবেদ আলী যার গাড়ি চালিয়েছেন, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা কিংবা তাকে নিয়ে ট্রল করা অনুচিত। তবে এটা ঠিক যে, নিজের ড্রাইভার, গার্ড ও পিয়ন চাপরাশিদের গতিবিধিতে নজর রাখা সৎ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। কিন্তু কতজন কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পালন করেন তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সরকারের উচ্চপদস্থ লোকদের কত শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে সৎ?

বলা হয় বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা সৎ তাদের বড় অংশ সৎ আসলে সুযোগের অভাবে। এর বাইরে সত্যিই পারিবারিক শিক্ষা, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে সুযোগ থাকার পরেও যারা দুর্নীতি করেন না—সেই সংখ্যাটি নিতান্তই কম। এর বড় কারণ বাংলাদেশের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিই দুর্নীতিগ্রস্ত। সৎ পথে উপার্জন করে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব বেশি ভালো থাকা দূরে থাক, নিজের পছন্দের মাছ-মাংস কেনাও সম্ভব হয় না—যদি না তার বৈধ উপায়ে বিকল্প আয়ের কোনো পথ থাকে কিংবা তিনি যদি পারিবারিকভাবে সচ্ছল হন। মূলত নিত্যপণ্যের বাজার তথা বেঁচে থাকার অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে নিজের বেতনের বিরাট ফারাক তৈরি হয়ে গেছে বলে অনেকে বাধ্য হয়ে নানারকম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

অনেকে শুরু করেন খুব ছোটখাটো চুরি, সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেওয়ার বিনিময়ে অল্প কিছু 'হাদিয়া' ইত্যাদি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এভাবে হাত পাকাতে পাকাতে একসময় অনেকে বড় চোর এবং চোর থেকে ডাকাতে পরিণত হন। নিচের দিকের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলো ঘটে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে যারা থাকেন, তারা সরকারি কেনাকাটা থেকে শুরু করে নানারকম প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় করার সুযোগ পান। উদ্ভট প্রকল্প বানিয়ে সেখান থেকে শত শত কোটি টাকা মেরে দেন। আবার যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের পাহারাদার, যেমন: বন-পাহাড়-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়—সেসব বিক্রি করেও অনেকে খেয়ে ফেলেন। যেমন: এক-এগারোর সরকারের সময়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন 'বনখেকো ওসমান গনি'। এবার সংবাদ শিরোনাম আরেক বনখেকো মোশাররফ—যার ছেলে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তারকা পুলিশ অফিসার।

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রশ্নফাঁস নিয়ে সংবাদ প্রচারের পরে আবেদ আলী, তার ছেলে এবং আরও অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৮ জুলাই সোমবার দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনজুড়ে আবেদ আলী এবং তার ছেলের নানা ছবি ভেসে বেড়িয়েছে। বিশেষ করে তার বিলাসবহুল বাড়ি, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে হোটেল, তার ছেলের কোটি টাকার গাড়ি, আবেদ আলীর ধর্ম ও জনসেবা—যেমন: মসজিদ বানিয়ে দেওয়া, মন্দিরে আর্থিক অনুদান দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সর্বোপরি আবেদ আলী কতটা পরহেজগার সেটি দেখা যায় তিনি যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ভেতরেই নামাজ পড়ছেন—এরকম ছবিও এসেছে। শুধু তাই নয়, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালিয়ে তিনি এতই সম্পদ অর্জন করেছেন যে, উপজেলা নির্বাচনেও প্রার্থী হতে চান। ভোট চেয়ে তিনি যে পোস্টার লাগিয়েছেন সেখানে লেখা, তিনি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে চান।

আবেদ আলীর ঘটনায় এখন যে বিষয়টি মীমাংসা করা দরকার তা হলো, নিশ্চয়ই তিনি একক প্রচেষ্টায় প্রশ্ন ফাঁস করতে পারেননি। বরং পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক লোক জড়িত। পিএসসির কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত, সেটি খুঁজে বের করা দরকার। অর্থাৎ জালের ছিদ্রটা কোথায় সেটা জানা দরকার। না হলে ছিদ্রটা বড় হতে হতে একসময় সেই জাল থেকে বড় মাছ, হাঙর ও কুমিরও বেরিয়ে যাবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, আবেদ আলী বিসিএসের কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছেন বা বিক্রি করেছেন—প্রিলিমিনারি নাকি লিখিত পরীক্ষা? শুধু বিসিএস নয়, আরও অনেক চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি ও তার চক্রের লোকজন ফাঁস করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। তারা যাদের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেছেন তাদের কতজনের চাকরি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি এখন প্রশাসনের বড় পদে থাকেন, তাদের নামগুলোও কি জানা যাবে?

তৃতীয়ত, আবেদ আলীর ফেসবুক ওয়ালে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবি দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক কী করে এসব মানুষের ঘনিষ্ঠ হতে পারলেন? তাদের সঙ্গে আবেদ আলীর সম্পর্ক কী? কে কার কাছ থেকে কী কী ‍সুবিধা নিয়েছেন? এখন এইসব প্রভাবশালী ব্যক্তি কি আবেদ আলীকে রক্ষার চেষ্টা করবেন?

চতুর্থত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসি এবং বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে আস্থা ছিল, সেটি আবেদ আলীর ঘটনায় কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সুতরাং পিএসসি কর্তৃপক্ষ এখন কি এ বিষয়ে একটা তদন্ত কমিশন করে পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখবে যে, সত্যিই কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে; কোথা থেকে কীভাবে হয়েছে; প্রতিষ্ঠানের কোন কোন পর্যায়ের লোক এর সঙ্গে জড়িত; প্রশ্ন ফাঁস করে কে কত টাকার মালিক হয়েছেন এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে কে কে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন? এসব তথ্য বের করা কি খুব কঠিন কাজ? পিএসসি কি নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় এই উদ্যোগটি গ্রহণ করবে?

সর্বোপরি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার—সেটি বাস্তবায়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার যে, তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে একটা সর্বাত্মক অভিযান শুরু করবে এবং শুধু নিচের বা মধ্যম সারির কর্মচারী নয়, বরং শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদেরও মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে—এরকম একটি ঘোষণা দেশবাসী এখন শুনতে চায়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Extreme weather events threatening food security

Since May last year, Bangladesh faced more than a dozen extreme weather events -- four cyclones, nine incidents of floods, and multiple spells of heavy rains, heatwaves, and cold waves -- and now they threaten food security..These events not only harmed individual farmers and food security

1h ago