এখন কি প্রশ্ন করা যাবে?

এখন যদি কেউ এই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাহলে তাকেও কি টেলিভিশনে না ডাকার ব্যাপারে আগের মতো অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হবে?

গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ ছিল এই যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, গণমাধ্যমকর্মীরাও ক্ষমতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের এমন কোনো প্রশ্ন করতে পারতেন না, যা তাদেরকে বিব্রত করে। অথচ গণমাধ্যমের প্রধান কাজই হলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা।

শাসকগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের কাছ থেকে অব্যাহত প্রশ্নের মুখে থাকে; গণমাধ্যম যদি সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যটি কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ও চাপমুক্ত থেকে প্রকাশ ও প্রচার করতে পারে—তাতে সেটি হোক রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা অন্য যেকোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তখন ওই সরকারের পক্ষে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসকে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।

অমর্ত্য সেন যেমন বলেছিলেন কোনো দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন হলে সেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না, তেমনি গণমাধ্যম স্বাধীন হলে বা সাংবাদিকরা নির্ভয়ে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারলে কোনো সরকারের পক্ষে গণবিরোধী বা স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার সুযোগ থাকে না। কেননা সরকার নিজেই তখন ভয়ে থাকে। কোনো একটি সরকার বা শাসক দল যখন জনগণকে ভয় না পায়; গণমাধ্যমকে ভয় না পায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তখন তার পক্ষে কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়া সহজ।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনটি যখন সহিংসতায় রূপ নিলো এবং আন্দোলনটি যখন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নিচ্ছিলো, তখনও কি দেশের গণমাধ্যমগুলো বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করেছে বা করতে পেরেছে? যদি না পারে তাহলে সিনিয়র সাংবাদিকরা কি কখনো প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই অভিযোগ করেছেন যে, তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সির ফোন ও প্রেস অ্যাডভাইসের কারণে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারছেন না? বাস্তবতা হলো, এই অভিযোগ করেও কোনো লাভ হতো না। কেননা রাষ্ট্রকাঠামোটিই গড়ে তোলা হয়েছিল এমনভাবে যে, এখানে গণমাধ্যমকে শুধু প্রশংসা করতে হবে। কেউ যদি প্রশ্ন করে তাহলে তাকে প্রতিপক্ষ, শত্রুপক্ষ, সরকারবিরোধী, বিএনপি-জামায়াত এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। মূলত এই ট্যাগিং বা চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে অনেকে সদিচ্ছা থাকার পরেও বস্তনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছেন। অথচ শুধুমাত্র সাংবাদিকরা যদি নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন এবং যা ঘটেছে বা ঘটছে—সেটুকুই প্রকাশ ও প্রচার করতে পারতেন, তাহলে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটি আপাত নিরীহ দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হতো না এবং তাতে শেখ হাসিনার মতো একজন শাসককে শুধু পদত্যাগ নয়, দেশ ছেড়েও পালাতে হতো না।

আসা যাক বর্তমান আমলে। প্রশ্ন হলো এখন কি প্রশ্ন করা যাবে? সাংবাদিকরা কি এখন ক্ষমতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা আছেন তাদেরকে প্রশ্ন করতে পারবেন নাকি প্রশ্ন করলে তাদেরকে 'আওয়ামী লীগের দালাল' বলে চিহ্নিত করা হবে? এই প্রশ্ন ও প্রত্যাশার হেতু, একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশ যাচ্ছে এবং নানা জায়গায় সংস্কারের কথা উঠছে। অনেক জায়গায় সংস্কার শুরুও হয়েছে। যেমন পুলিশ বাহিনীর পোশাক ও লোগো বদলে যাচ্ছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিচার বিভাগের সকল কর্মকর্তাকে সম্পদের হিসাব দিতে বলেছেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গিয়ে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও এই পরিবর্তন ও সংস্কারের ছোঁয়া লাগবে—সেটিও মোটামুটি নিশ্চিত। সেই ধারাবাহিকতায় এখন প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকতা কি আগের মতোই চলবে নাকি এখন নির্ভয়ে প্রশ্ন করা যাবে? যে প্রশ্ন শুনলে ক্ষমতাবানরা বিব্রত হন, সেরকম প্রশ্ন করার মতো পরিবেশ গড়ে উঠবে কি না?

গত ১৩ আগস্ট একজন সিনিয়র সাংবাদিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানালেন, ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি তার পোর্টালে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য একটি ফোনও পাননি। অথচ রাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা বাহিনীর তরফে প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে কমবেশি ফোন আসতো। সেই ফোন কখনো সংবাদটি কেন প্রকাশিত হলো তার কৈফিয়ত তলব; কখনো মৃদু ভর্ৎসনা, কখনো পরামর্শ। কিন্তু ৫ তারিখের পরে কোনো বাহিনী বা সংস্থার তরফে তার কাছে এরকম কোনো ফোন আসেনি।

প্রশ্ন হলো, এই ধারা কি অব্যাহত থাকবে? সাংবাদিকরা নির্ভয়ে এবং স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে কি সাংবাদিকতা করতে পারবেন নাকি কিছুদিন পরে আবারও ফোন আসা শুরু হবে?

বছরের পর বছর ধরে জনপরিসরে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, আর যাই হোক প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বিপক্ষে যায় এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না। যদিও অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়েছে। অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। আবার এসব সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানকে নানারকম হয়রানিরও শিকার হতে হয়েছে। শুধুমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়াই নয়, বরং অনেক সাংবাদিককে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা কি সেই লিগ্যাসি বহন করবে নাকি এখন নির্ভয়ে প্রশ্ন করা যাবে এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা যাবে?

কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ ওঠে কিংবা কারো বিষয়ে যদি নাগরিকদের তরফে কোনো ধরনের সংশয় তৈরি হয়, গণমাধ্যম কি নির্ভয়ে সেই সংশয়ের কথা লিখতে পারবে?

সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে অনেকে এই বিজয়কে যে 'দ্বিতীয় স্বাধীনতা' বলছেন—এর যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে বা কোনো টেলিভিশন চ্যানেল এই বিষয়ে টকশো করলে ওই টকশোয়ের উপস্থাপক ও অতিথিদের কি হয়রানির মধ্যে পড়তে হবে?

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে এমন একজন আছেন, যাকে বিগত বছরগুলোয় টেলিভিশনের টকশোতে ডাকার ওপর সরকারের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। একটি টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া তিনি অন্য কোথাও যেতে পারতেন না বা তাকে ডাকা যেত না। শুধু তিনি একা নন, আরও অনেক সাংবাদিককেও বিগত বছরগুলোয় টেলিভিশনে দেখা যেতো না—যাদের অনেককে এখন দেখা যাচ্ছে। বিগত দিনে তাদেরকে না ডাকার ব্যাপারে নির্দেশনা ছিল। প্রশ্ন হলো, এখন যদি কেউ এই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাহলে তাকেও কি টেলিভিশনে না ডাকার ব্যাপারে আগের মতো অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হবে?

গণমাধ্যমের মূল কাজ প্রশ্ন করা। সুতরাং এখন কি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা যাবে নাকি আগের মতোই ক্ষমতাবানদের প্রশ্নের চেয়ে প্রশংসা বেশি করতে হবে এবং তারা অখুশি হন এমন প্রশ্ন করার আগে তিন বার ভাবতে হবে? এখনও কি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকেও উসকানিমূলক অভিযোগ তুলে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে সাংবাদিককে জেলে ভরা হবে? গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করে এমন আইনের প্রয়োগ কি অব্যাহত থাকবে?

এরকম অসংখ্য প্রশ্নের মধ্যেই স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা দূর করার আহ্বান জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে বাকস্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের স্বার্থে স্বাধীন সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার নিবর্তনমূলক বিশেষ আইনগুলো অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন ও আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার ও বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, গণআন্দোলনের সময় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল অফিস আক্রান্ত হয়েছে, সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা সম্পাদক পরিষদ সমর্থন করে না। একইসঙ্গে পেশাদারিত্ব বাদ দিয়ে নীতিবিবর্জিত ও লেজুড়বৃত্তির সাংবাদিকতা বর্জনীয় বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

এই দাবিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু বলাই হয়, আইনে কী আছে কিংবা সরকারের নীতিমালা কী—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের ইনটেনশন কী? অর্থাৎ সরকার যদি মনে করে যে সে কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করবে না বা প্রশ্ন করাকে সে যদি সরকারের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার সামিল মনে করে এবং প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক ও গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানকে তার প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে, তাহলে আইন ও নীতিমালায় যা কিছুই থাকুক না কেন—তাতে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন সাংবাদিকতা যেমন হবে না, তেমনি এই ধরনের চাপযুক্ত ও ভয়মিশ্রিত সাংবাদিকতা শেষ পর্যন্ত সরকারের গদিও রক্ষা করতে পারবে না।

বলা হয়, প্রশ্নহীন সমাজের গন্তব্য অন্ধকার। সুতরাং শুধু গণমাধ্যম নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রশ্ন করার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। না হয় আজ গণঅভ্যুত্থানের মুখে একটি সরকারের পতন হলো, কাল আরেকটি অভ্যুত্থান হবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments