প্রথমে মনোযোগ দিতে হবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়, বিষয়বস্তুতে নয়

সংবিধানটি একেবারে নতুনভাবে লেখা হোক বা বিদ্যমান সংবিধানের সংশোধন হোক, জনসম্পৃক্ততার প্রক্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে এবং হওয়া উচিত।
ইলাস্ট্রেশন: আনোয়ার সোহেল

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগের পর প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলম বারবার নতুন জনগণের ইচ্ছার ধারণা তুলে ধরে বলেন, 'একটি নতুন জনগোষ্ঠী' আবির্ভূত হয়েছে এবং এই নতুন জনগণের ইচ্ছাই বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে রূপ দেবে।

এই অনুষ্ঠানটি সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল। এই লেখায়, আমরা সাংবিধানিক নকশা সম্পর্কিত দুটি বিস্তৃত দিক তুলে ধরছি, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তরিকভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানাই।

ঢাকার নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ফোরামে ইতোমধ্যেই নতুন সংবিধানের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি এই নিয়ে বিতর্ক চলছে যে আমাদের কি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রয়োজন, নাকি শুধু বিদ্যমান সংবিধানটি সংশোধন করা উচিত।

কিন্তু আমাদের মনোযোগ এখনই বিষয়বস্তুর ওপর কিংবা কীভাবে খসড়া প্রণয়ন করবো অথবা আমরা কি নতুন করে শুরু করবো নাকি শুধু সংশোধন করবো—সে বিষয়ে দেওয়া উচিত হবে না। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে একটি 'প্রক্রিয়া' প্রতিষ্ঠা করার ওপর, যা একটি চূড়ান্ত অনুমোদিত সংবিধানের দিকে নিয়ে যাবে। সেই প্রক্রিয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘোষণা করা উচিত।

একটি নতুন জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়া নতুন যুগের জন্য শুধু যে একটি নতুন সাংবিধানিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন, তা নয়; বরং এমন একটি নতুন প্রক্রিয়া প্রয়োজন, যা সেই বন্দোবস্তে পৌঁছাতে পারে।

২০১৮ সালের গণভোটে আইরিশ জনগণ গর্ভপাতের বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা বাতিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এই আলোচনায় গর্ভপাতের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়; আমরা বরং এই উদাহরণ থেকে যা দেখছি তা হলো, আইরিশরা নিষেধাজ্ঞা সরানোর আগে কী করেছিল এবং গণভোটের পর কী ঘটেনি।

এই গণভোটের আগে আয়ারল্যান্ডে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন সম্প্রচারিত নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে গর্ভপাত এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের সংসদসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। এই সমাবেশগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হয়েছিল। গণভোটের ফলাফলে দেখা যায়, ৪০টির মধ্যে ৩৯টি আসনে গর্ভপাতকে বৈধ করার পক্ষে ভোট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেখানে যা ঘটেনি তা হলো, জনসাধারণের মধ্যে কোনো তিক্ততা বা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধ।

ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে আয়ারল্যান্ডে এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল বিষয়। সবাই বুঝতে পেরেছিল যে গণভোটের প্রক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল ভোটারদের ইচ্ছার যথাযথ প্রতিফলন।

অন্যদিকে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে চিলির জনগণ দুইবার নতুন সংবিধানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ, এই গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল স্বৈরশাসক অগুস্তো পিনোচেটের শাসনামলে তৈরি ব্যাপকভাবে ঘৃণিত সংবিধান বাতিল করতে। বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত মতামত অনুযায়ী তৈরি করা উভয় সংবিধানের খসড়াই পাশ করাতে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ এগুলো তৈরি করেছিল বিভিন্ন গোষ্ঠী—প্রথমবার বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি এবং দ্বিতীয়বার ডানপন্থী শক্তি। তারা ভেবেছিল যে তারা জাতির কল্যাণে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে তারা ছিলেন জনগণের উদ্বেগ থেকে অনেক দূরে।

সংবিধান প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে জনসম্পৃক্ততার গুরুত্ব নিয়ে একটি বিস্তৃত ঐক্যমত রয়েছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন জনসম্পৃক্ততার একটি প্রবণতাকেও প্রতিফলিত করে। একটি সংবিধান আইনপ্রণেতাদের পাস করা আইনেরও উপরে থাকায় এর গুরুত্ব সর্বোচ্চ।

একটি নতুন সংবিধান শুধুমাত্র ঢাকার অভিজাতদের হাতে রচিত হওয়া উচিত নয়। বরং শুরু থেকেই জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে রচিত হওয়া উচিত।

সর্বাধিক জনসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে রচিত একটি সংবিধানের সর্বাধিক বৈধতা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি, যা এটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে এটিকে পরাভূত করার কিংবা পালটে ফেলার যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে আরও প্রতিরোধী করবে।

সংবিধান প্রণয়ন ও নকশা বিষয়ক পণ্ডিতরা এই প্রক্রিয়াকে 'আওয়ারগ্লাস মডেল' বলে অভিহিত করেন। আওয়ারগ্লাসের মতো এটি উপরের দিকে প্রশস্ত থাকে, যেখানে জনসাধারণের মতামত, আলোচনা ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। এরপর এটি মাঝখানে সংকুচিত হয়, যেখানে একটি পরামর্শমূলক এবং প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নকারী সংস্থা কাজ করে। পরে এটি আবার জনগণের কাছে ফিরে আসে, নির্বাচিত হয় সাংবিধানিক পরিষদের মাধ্যমে, অথবা গণভোটের মাধ্যমে, অথবা উভয়ের সমন্বয়ে। এরপরে আসে অনুমোদনের ধাপ। জনসম্পৃক্ততার প্রক্রিয়াটি সত্যিকার অর্থে অর্থবহ হতে হবে এবং তা যেন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার জন্য না করা হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

সংবিধানটি একেবারে নতুনভাবে লেখা হোক বা বিদ্যমান সংবিধানের সংশোধন হোক, জনসম্পৃক্ততার প্রক্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে এবং হওয়া উচিত।

এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ার নকশার প্রতিটি স্তরে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি উপজেলা বা আরও তৃণমূল স্তরে জনসাধারণের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে এবং আলোচনাটিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেন্দ্রীভূত রাখতে আলোচনা পরিচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়গুলো কভার করার জন্য একটি ভিডিও প্রাইমার প্রকাশ করতে পারে। তবে এ ব্যপারে সতর্ক থাকতে হবে, যেন বৈধ জনআলোচনার ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ না হয়।

একটি আলোচনামূলক এবং প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নকারী সংস্থার পর্যায়ে এর গঠন সম্পর্কে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে। এই সংস্থাটিকে কি জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করতে বলা উচিত? একটি সাংবিধানিক পরিষদের সদস্যরা কারা হবেন? বর্তমান বা সাবেক নির্বাচিত কর্মকর্তাদের কি পরিষদে নিষিদ্ধ করা উচিত এবং পরিষদের সদস্যদের ভবিষ্যতে অফিসে বসা নিষিদ্ধ করা উচিত? এমন প্রশ্নগুলোও জনসাধারণের আলোচনার অংশ হতে পারে।

প্রক্রিয়া নকশায় উপরের স্তরের এবং নিচের স্তরের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করতে হবে। নিচের স্তরের কাজগুলো—যেমন: একটি আলোচনামূলক সংস্থা—জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজ যা দেবে তার মাধ্যমে প্রভাবিত হবে। একইভাবে, যেহেতু জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজ—উপরের স্তরের ভিত্তি—জানবে যে তারা যা জমা দেবে তা একটি আলোচনামূলক ও প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নকারী সংস্থার মাধ্যমে যাবে এবং তারপর একটি সাংবিধানিক পরিষদ বা গণভোটে যাবে, তারা তাদের মতামত সেই অনুযায়ী দেবে। এই ধরনের প্রভাবগুলো সাবধানে বিবেচনা করতে হবে।

যেগুলো বিবেচনায় নিতে হবে এগুলো তার মধ্যে অল্প কিছু। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো কাজে লাগানো উচিত।

এসব বিশদ আলোচনা আমাদের দ্বিতীয় বিষয়টির দিকে নিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াটি চালানোর জন্য প্রয়োজন হবে পরিচালনার দক্ষতা, আইনি দক্ষতা নয়। বহু বছর ধরে আমরা স্বৈরশাসক শাসন সহ্য করেছি, যা আমাদের প্রশাসনিক খাত, সিভিল সার্ভিসের মান অবনমিত করেছে। এটি স্বীকার করতে আমাদের কষ্ট হয়। জনসম্পৃক্ততা সহকারে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে হলে আমাদের সেরা ও মেধাবীদের যুক্ত করতে হবে। যদি প্রভাবশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিরা মুখপাত্র হিসেবে থাকেন, তবুও দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি অবশ্যই দক্ষ মানুষদের হাতে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত চ্যানেলের বাইরের লোকদেরও যুক্ত করা যেতে পারে।

ভবিষ্যতে আমরা সাংবিধানিক ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব। আমরা এই অংশটি দিয়ে শুরু করছি কারণ, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুক, যেখানে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে, যেখানে উল্লেখ থাকবে যে আমরা সবাই কীভাবে নতুন জনগণের সঙ্গে একটি নতুন বাংলাদেশের দিকে, একটি নতুন সংবিধানের দিকে অগ্রসর হবো।

 

জিয়া হায়দার রহমান একজন সাবেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রধান এবং 'ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো' উপন্যাসের লেখক। তার এক্স হ্যান্ডেল @ziahaiderrahman

মনজুর হাসান একজন ব্যারিস্টার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক এবং ইউএসসিএসি কোয়ালিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। তার এক্স হ্যান্ডেল @Manzoor_Hasan

Comments

The Daily Star  | English

The psychological costs of an uprising

The systemic issues make even the admission of one’s struggles a minefield

10h ago