মতামত

বিএনপি কি নিজেদের ঘর পরিষ্কার করবে?

যুবদল নেতা ভিআইপি রুম না পাওয়ায় মহাখালীতে অনুসারীদের রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার ভাঙচুর। ফাইল ছবি | সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পলায়নের পর বিএনপি যে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল—এটা নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। সব রাজনৈতিক দলই জনগণের হয়ে কথা বললেও জনগণ সব দলের কথা শোনে বা কানে নেয় বলে মনে হয় না। বিএনপি যেহেতু ধারণাগতভাবে বড় দলের বিবেচনায় আছে, সেহেতু বিএনপি নিয়েই আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা যাক।

আওয়ামী লীগহীন রাজনীতির মাঠে বিএনপির পা রাখার এই সময়ে দলটির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অন্য কেউ নয়, নিজেরাই। আওয়ামী শাসনের অত্যাচারে দলের অনেক নেতাকর্মী বছরের পর বছর ঘরছাড়া থাকতে বাধ্য হয়েছেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ঘরে ফিরে এখন তাদের নিজেদের ঘর সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কেন বিএনপির ঘর সামলানো কঠিন হচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে? কোনো কিছুই তো আর গোপনে হচ্ছে না। সবাই দেখছে সবার চেহারা। আমি নতুন করে বয়ান করতে গেলে সেটা বরং মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলার মতো মনে হতে পারে!

বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, দলীয় পরিচয়ে দখল, নারী নিপীড়নসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে যখন বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, তখন দলীয়ভাবেই কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তার কার্যকারিতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি দুইটি আলোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে এই সংকট আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে—একটি ঘটেছে দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে, আরেকটি রাজধানী ঢাকায়। এই দুই ঘটনার সূত্র ধরে বিএনপির ভেতরে বিরাজমান রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও নৈতিক সংকট জনসমক্ষে আরও স্পষ্টতর হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলা থেকে পাথর ও বালু বহনকারী যানবাহনের চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। বুধবার (২ জুলাই) দিবাগত রাত ১টা ১৩ মিনিটে তার ভ্যারিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে সারজিস আলম অভিযোগ করেন, পাটগ্রামে সরকার অনুমোদিত পাথর ও বালুর সাইট থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া গাড়িগুলোর কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামে। এই নিয়মিত চাঁদাবাজির ফলে প্রতিদিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

এই পোস্টে তিনি আরও জানান, পাটগ্রামের ইউএনও সম্প্রতি চাঁদাবাজদের মধ্য থেকে দুজনকে আটক করে তাদের এক মাসের কারাদণ্ড দেন। কিন্তু এরপরই বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকশ নেতাকর্মী থানা ঘেরাও করে, ভাঙচুর চালিয়ে আটককৃতদের জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এমনকি জেলার পুলিশ সুপার হাতীবান্ধা থানা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স চাইলে সেখানকার বিএনপি নেতাকর্মীরা সেই থানাও ঘেরাও করে রাখে। সারজিস আলম সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, যদি বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন থেকেই এইভাবে প্রশাসনকে জিম্মি করে চাঁদাবাজদের রক্ষা করে, তাহলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন হবে?

তিনি আরও অভিযোগ করেন, পাটগ্রামে বিএনপির একজন এমপি প্রার্থী এসব চাঁদাবাজদের প্রত্যক্ষ মদদ দিচ্ছেন। যদিও তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি, তবে স্থানীয়রা বলছেন এই গোষ্ঠীচালিত রাজনীতি পাটগ্রামে এখন চলছে এবং কেউ মুখ খুললেই তাকে দমন করা হয়। সারজিস তার পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ট্যাগ করে এই ঘটনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে আহ্বান জানান।

অন্যদিকে ঢাকায় ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা বিএনপির যুবদল নেতৃত্বের মধ্যে কী ধরনের অসংযত ও অপরাধপ্রবণ আচরণ ঢুকে পড়েছে তা প্রকাশ করে। ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের বনানী থানার আহ্বায়ক মনির হোসেন রাজধানীর মহাখালীর একটি হোটেলে গিয়ে 'ভিআইপি রুম' না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বারে বসে খাওয়া-দাওয়ার পর হুমকি-ধামকি দেন। এরপর তার ঘনিষ্ঠ লিটন চৌধুরী নাহিদসহ আরও কয়েকজন হোটেল ও বারটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়, নারীসহ কর্মীদের মারধর করে এবং তাদের হুমকি দেয়—যদি বিষয়টি পুলিশের কাছে জানানো হয়, তাহলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে দিতে হবে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে নারীদের ওপর আক্রমণ, মেঝেতে ফেলে দেওয়া এবং চিৎকার-চেঁচামেচির ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়।

এই ভিডিও প্রকাশের পর বিএনপি যদিও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এক বিজ্ঞপ্তিতে মনির হোসেনকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ বহিষ্কার করে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই বহিষ্কার কি শুধুই জনদৃষ্টিকে শান্ত রাখার একটি প্রতিক্রিয়া, নাকি বাস্তব সংস্কারের শুরু?

এখন প্রশ্ন উঠছে, এত সব শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় কাদের? তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বিএনপি অন্তত ১ হাজার ৩১ জন নেতাকে কেন্দ্রীয়ভাবে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিয়েছে, আরও ১ হাজার ২০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জেলা, মহানগর, উপজেলা পর্যায়ে আরও বহু নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল মিলিয়ে এই সংখ্যা কয়েক হাজার। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এসব শাস্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। যারা দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধের শিকার, তারাই মূলত শাস্তি পাচ্ছেন; কিন্তু যারা প্রভাবশালী, তাদের ছুঁতে পারছে না কেউ।

এ রকম পরিস্থিতি বিএনপিকে যে শুধু জনসমর্থন হারানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা নয়, বরং এটি দলীয় কাঠামোর ভেতরে এক আত্মধ্বংসী প্রবণতাকেও উসকে দিচ্ছে। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, এমনকি জেলা ও মহানগর পর্যায়ে একাধিক গ্রুপ একে অন্যকে দোষারোপ করছে, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে এবং এপ্রিল মাসেই অন্তত সাতজন নেতাকর্মী দলীয় কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এই সংখ্যাটি ৫০ ছাড়িয়ে গেছে বলে নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির মুখে সংস্কারের কথা যতই শোনা যাক না কেন, মানুষ সেটিকে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নয় বরং বাহ্যিক প্রচারণা বলেই মনে করছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপির করণীয় পরিষ্কার। প্রথমত, দলের ভেতরে নিরপেক্ষ ও কঠোর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা কোনো প্রভাবশালী নেতার জন্যও রেয়াত রাখবে না। দলে থেকে কেউ যদি অন্যায় করে, তবে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনানুগ শাস্তিকেও সমর্থন জানাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ নারী লাঞ্ছনায় জড়ায়, দল থেকে বহিষ্কার করেই ক্ষান্ত হওয়া চলবে না; বরং ভুক্তভোগী যাতে নিরাপদে আইনি সহায়তা পান, সে জন্য দলকেও উদ্যোগ নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মাঠপর্যায়ের সংগঠকদের কার্যকলাপ এবং রাজনৈতিক চর্চা দলীয় পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য যারা আগ্রহী, তারা যেন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মদদ না দেয় বা নিজেরা দখলদারি না করে, সেটা দলীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নয়, বরং নিরপেক্ষ তদারকি কাঠামো গঠন জরুরি। স্থানীয় অভিযোগগুলো কেন্দ্রীয় ফোরামে পৌঁছার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য চ্যানেল থাকা দরকার, যাতে তৃণমূলের আওয়াজকে গুরুত্ব দেওয়া যায়।

তৃতীয়ত, বিএনপিকে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে হবে। এখনো অনেকের চোখে বিএনপি 'আওয়ামী বিরোধী একটি দল' হিসেবেই পরিচিত, যার নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন বা শাসন পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। বারবার 'শেখ হাসিনার পতন'-কে মূল লক্ষ্য বানিয়ে ফেললে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা একমুখী হয়ে পড়ে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর দলটি কীভাবে প্রশাসন চালাবে, বিচারব্যবস্থা বা স্থানীয় সরকারে কী সংস্কার আনবে, তা এখন থেকেই জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। নতুবা একে একে উচ্ছ্বসিত গণআশা হতাশা হয়ে যাবে।

বিএনপির কিছু অভিযোগ সত্য হতে পারে—ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ তাদের অপপ্রচারে ব্যস্ত, জামায়াতের অনুগত কিছু ছাত্রনেতা বা প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে সক্রিয়, সরকার-ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারাও তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই দায় দিচ্ছেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি দল নিজের ভেতরের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকে, তা হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা দলেরই হবে। বিএনপি যদি মনে করে সত্যিই তারা গণমানুষের দল, তবে তাদের শক্তি এবং জনআস্থা ফিরে পেতে হলে আগে নিজেদের ঘর পরিষ্কার করতে হবে।

একটা রাজনৈতিক দল কখনোই নির্ভুল হয় না—কিন্তু ভুল স্বীকার করে তা সংশোধনের সদিচ্ছা থাকলে মানুষ তা ক্ষমা করে। এখন দেখার বিষয় বিএনপি এই সদিচ্ছা ও সক্ষমতা দেখাতে পারে কি না। এখন স্লোগানের সময় নয়, বাস্তব সংস্কার দেখানোর সময়। যারা দখল, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়নের মতো ঘটনাকে তুচ্ছ ভাবছে, তাদের সঙ্গে আপস না করাই ভবিষ্যতের নেতৃত্বের প্রথম চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত।

Comments

The Daily Star  | English

3 die of dengue as daily hospitalisations hit record high this year

Nearly 500 patients admitted in 24 hours as total cases rise to 12,763

1h ago