বইয়ের রিভিউ

বিস্তৃত ক্যানভাসে এই বাংলার ক্রিকেট

হুট করেই কোন শিশু পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠে না। তাকে পেরুতে হয় নানা ধাপ, তার চিন্তার আদল, তার দক্ষতা, তার সংস্কৃতি নানান পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকে। পূর্ণতা পাওয়ার পর টোকা মারলে তার বেড়ে উঠার সময়ের নির্যাসের ঘ্রাণ একটু হলেও বেরিয়ে আসে। তাই নিজেকে বুঝতে হলেও একবার পেছনে ফিরে তাকানো দরকার।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস বলতে আমরা কি জানি? আশির দশকে প্রথম ওয়ানডে খেলা, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা লাভ। তারপর একটু একটু করে এগুনো। কিন্তু দেশের জন্মের আগেও এই অঞ্চলটা তো ছিল। তখন ক্রিকেটের কি অবস্থা ছিল? কিংবা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগের চিত্রটা ছিল কেমন? তা নিয়ে আগ্রহ খুব বেশি লোকের দেখা যায় না। যদিও সেসব জানা এই অঞ্চলের ক্রিকেট বোঝার স্বার্থেও বেশ কাজে দিতে পারে। লুৎফুর রহমান মাখনের 'ক্রিকেটের সাথে চলা' নামের বই সেদিক থেকে দারুণ সহায়ক গ্রন্থ। 

হুট করেই কোন শিশু পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠে না। তাকে পেরুতে হয় নানা ধাপ, তার চিন্তার আদল, তার দক্ষতা, তার সংস্কৃতি নানান পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকে। পূর্ণতা পাওয়ার পর টোকা মারলে তার বেড়ে উঠার সময়ের নির্যাসের ঘ্রাণ একটু হলেও বেরিয়ে আসে। তাই নিজেকে বুঝতে হলেও একবার পেছনে ফিরে তাকানো দরকার।

লুৎফুর যতটা পেছনে যাওয়া যায় ততটা গিয়ে টেনে এনেছেন এক সময়ের পূর্ব বাংলা তথা এখানকার বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস। এ ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে তিনি নিজেই অবস্থান করছিলেন সেই সময়গুলোতে, নিজে বেড়ে উঠেছেন ক্রিকেটের সঙ্গে, খেলেছেন তখনকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের মঞ্চে। অনেকটা আত্মজীবনীর স্বরে তিনি মেলে ধরেছেন বেশ কিছু ছবি। যা কোলাজ করে বড় করে এগিয়ে নিলে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি এখনকার সময়।

দেশভাগের আগে পূর্ব বাংলার ক্রিকেটের কথা আমি নানান বইয়ে পেয়েছি। সেই সময়কার অনেক নামকরা সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদদের ক্রিকেটের প্রতি একটা অনুরাগ ছিল। টেস্ট ক্রিকেটকে তারা তখন সঙ্গীতেরই মূর্ছনার মতনই শিল্পমান দিয়ে কদর করতেন।  আমাদের এই অঞ্চলের সন্তান পরে ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্রের 'আপিলা-চাপিলা' বইতে জানতে পারি ঢাকা থেকে দলবেঁধে তখন কলকাতার ইডেন গার্ডেনে গিয়ে টেস্ট দেখার স্মৃতি। পুরনো ঢাকায় বিভিন্ন ক্লাব গড় তোলা, পল্টন মাঠে ক্রিকেটের জোয়ার। তিনি জানান এই অঞ্চলের কেউ কেউ সর্ব ভারতীয় দলে খেলার জন্যও বিবেচনায় ছিলেন। কুমিল্লার ছেলে প্রবীর সেন ভারতের টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন ভারত মানে ব্রিটিশ ভারত। আজকের পাকিস্তান, বাংলাদেশ সবই ছিল যার অংশ।

লুৎফুরও তার বইতে প্রথমেই আমাদের প্রবীরের খবর দেন। যার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল অবশ্য দেশভাগের পর।

আরও পেছনে গিয়ে তিনি যেসব ইতিহাস সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন সেসব ইতিহাস আরও কারো কারো লেখায় পাওয়া যায়। সেই ১৮৭০ সালে কিশোরগঞ্জে সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষ সারদারঞ্জন রায় তার চার ভাইকে নিয়ে শুরু করেছিলেন ক্রিকেট। লম্বা দাঁড়ির কারণে 'বাংলার ডাব্লিউ জি গ্রেস' হিসেবে পরিচিত ছিলেন সারদারঞ্জন। ১৮৮৪ সালে গঠন করেছিলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। আমরা জানতে পারি নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্র রায়ের কথা। যিনি নিজে ক্রিকেট খেলতেন। নাটোর একাদশ নামে দল বানিয়ে সেই দলের কোচ করেছিলেন সারদারঞ্জনকে।

সারদারঞ্জন, জগদীন্দ্ররা ১৯০০ সালের আগেই এই অঞ্চলে ক্রিকেটের ভিত রচনা করেছিলেন। তাদের এই অঞ্চলে ক্রিকেটের অগ্রদূত হিসেবেই প্রতিভাত করেছেন লেখক। 

দেশভাগের আগে ও পরে ময়মনসিংহের ক্রিকেটে নিয়ে অনেক গল্প জানান লুৎফুর। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত পন্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবের সেইসময় ক্রিকেটের অবদান আজকের যেকোনো ক্রিকেট ভক্ত জানলে হয়ত অবাক হবেন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের শহর ময়মনসিংহে ক্রিকেটের জোয়ার বিস্ময়ের চোখে ধরা দিতে পারে। কিন্তু সেসবই ছিল বাস্তব। ক্রিকেটের ভিত, ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি তৈরিতে যা বড় ভূমিকা রেখেছে। অনেকের ভেতর স্থায়ীভাবে ক্রিকেটের পোকাও ঢুকিয়েছে যা।

দেশভাগের পরে প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতায় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উলটপালট হয়েছে অনেক কিছু। তখনকার অনেক ক্রিকেটার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং অবস্থাপন্ন।  ক্রিকেট যেহেতু উচ্চবিত্তদের খেলা ছিল, তাদের চলে যাওয়ায় একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অবাঙালিদের একটা অংশ সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন। একধরণের পালাবদল ঘটেছে বলা যায়।

দেশান্তরির ঘটনা পাকিস্তান আমলেও চলেছে নানান ধাপে। লুৎফুর তার সতীর্থ সুকুমার গুহের খবর দেন। যিনি খেলতেন পূর্ব পাকিস্তান দলে, বেশ ভালো ব্যাটার ছিলেন। ১৯৬৫ সালের পর 'চরম দুঃখজনক ঘটনায়' (এভাবেই লিখেছেন)  চলে যান কলকাতায়। সুকুমারকে বৃদ্ধ অবস্থায় কলকাতায় গিয়ে পরে খুঁজে পেয়েছিলেন লুৎফুর, ২০২০ সালে করোনায় মারা যান তিনি। সেই স্মৃতিচারণও অন্য একটা বাস্তবতার ছবি তুলে ধরে, কিছুটা আবেগাক্রান্তও করে।

এই বইতে আজকের মাঠ সংকটের কথা এসেছে বারবার। এক সময় ঢাকায় কত মাঠ ছিল, সেই বর্ণনা শুনিয়ে আমাদের হাহাকার তৈরি করেছেন লেখক। এমন দারুণ সব মাঠে তার খেলার অভিজ্ঞতা লিখেছেন যেসব আজ বিকট অট্টালিকার নিচে চাপা।

মাঠ দখলের সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে ষাটের দশকেই। সেই সময়কার আমাদের ক্রীড়া সংগঠকদের পরিকল্পনাহীনতা, অদক্ষতার খবরও মিলে তার বইতে। পরিকল্পনাহীনতা, অদক্ষতার এই ধারাবাহিকতা আশ্চর্যজনকভাবে আজও বয়ে চলেছি আমরা।

লেখক তার বই ঋদ্ধ করেছেন দুষ্প্রাপ্য সব স্কোরকার্ডে। এই অঞ্চলের প্রথম প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, সামার ক্রিকেটের মতন ঘরোয়া আসর, পাকিস্তান, ভারত, এমসিসি এসব দলের সফরের অমূল্য সব স্কোরকার্ড যুক্ত আছে বইতে। তিনি নিজেই স্কোরকার্ড সংগ্রহ করতেন। এরকম নথি সবচেয়ে সমৃদ্ধ ক্রিকেট পোর্টালেও আজকাল আর পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বেশ কিছু ছবি, পরম যত্নে তা তাই সংগ্রহ করার মতন।

বাংলাদেশের জন্মের আগে, জন্মের সময় ও ঠিক পরের এখানকার ক্রিকেটের মোটা দাগের ছবি আমরা পাব এই বইতে। বেশ কিছু জ্বলজ্বল করা নাম আমরা পাব। যাদের কারো কারো কথা কিছু আমরা জানি, অনেকটা জানি না।

১৯৯১/১৯৯২, ১৯৯৭/৯৮ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত ছিলেন লুৎফুর। তার সংগঠক জীবনের কথা তিনি এই বইতে কিছু লেখেননি, লিখলে ভালো হতো। আমরা জানতে পারতাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার ঠিক আগে আগের বাস্তবতা। এই জায়গায় একটু খামতি থেকে গেলো বলা যায়। [এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর লেখক জানিয়েছেন তিনি তার সংগঠক জীবনের কথা আরেকটি বইতে বিশদ লিখেছেন। 'যখন নির্বাচক এবং আমার ক্লাব' বইটি তিনি আমাকে কুরিয়ার করে পাঠিয়েছেন। খামতি থাকার ব্যাপারটি আর রইলো না।] 

সব মিলিয়ে বইটি সুখপাঠ্য। যারা কেবল কয়েকটি ঘটনার বাইরেই এই অঞ্চলের ক্রিকেটেকে বিশদ পরিসরে জানতে চান সেইসব ক্রিকেট অনুরাগীদের ভেতর এটি প্রবল রোমাঞ্চ তৈরি করবে। গত মার্চে বইটি প্রকাশ করেছে সৌম্য প্রকাশনী। 

Comments