টেস্ট ক্রিকেটের জয়গান

ওভাল টেস্ট শেষ হওয়ার পর ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে লিখেছেন, 'টেস্ট ক্রিকেট হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলা।' কারো কারো ভ্রকুঞ্চিত হতে পারে। একি! একেবারে সব খেলার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ! এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু ক্রিকেটের সব সংস্করণের মধ্যে যে টেস্টই শ্রেষ্ঠ এটা নিয়ে বোধহয় কারো সংশয় নেই।
ভারত-ইংল্যান্ডের পাঁচ টেস্টের সিরিজের প্রতিটি ম্যাচই গেছে পঞ্চম দিনে, এমনকি শেষ ঘণ্টা পর্যন্তও দোলাচল ছিলো একাধিক ম্যাচে। টেস্ট ক্রিকেট চারদিনে নামিয়ে আনার যে আলোচনা সেটাকেই যেন একদম মোক্ষ জবাব এই সিরিজ। টেস্ট ক্রিকেট মৃত্যু পদযাত্রী নয় বরং ভীষণভাবে দীপ্যমান এই বার্তা দেওয়ারও সিরিজ। ২০০৫ সালের অ্যাশেজের পর আর কোন সিরিজে এত নাটকীয়তা, এত কীর্তি, এত তীব্র লড়াই, এতরকমের গল্পের ভিড় দেখা যায়নি।
রমরমা টি-টোয়েন্টির যুগে টেস্টের আগামী নিয়ে শঙ্কার অনেক কথা কদিন পর পরই শোনা যায়। এই ব্যাপারে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রার বলা কথা প্রাসঙ্গিক হতে পারে, 'আমি টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু ভারত-অস্ট্রেলিয়া, ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ দেখার পর আমি জোর দিয়ে বলছি টেস্ট ক্রিকেট বেঁচে আছে এবং ভালো আছে।'
ওভালে সোমবার পঞ্চম দিনে এক ঘণ্টার বেশি খেলা হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ ম্যাচের বাকি ছিলো অল্পই। তবু পুরো গ্যালারি হয়ে যায় ভরপুর। ইংল্যান্ডের ৩৫ রান নাকি ভারতের ৪ উইকেট- এই রোমাঞ্চ মিস করতে চাননি দর্শকরা। এই উচ্চতর স্তরের রোমাঞ্চে তাদের নিয়ে এসেছে বিগত ছয় সপ্তাহ, ২৪ দিন, ৭২ সেশন। দুরন্ত ব্যাটিং, চোখ ধাঁধানো সব স্পেল, আহত হয়েও নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার যত নিবেদন। কোণঠাসা হয়েও হাল না ছাড়ার যত গল্প।
এক বাঙালি সাহিত্যিক টেস্ট ক্রিকেটকে তুলনা করেছিলেন মানবজীবনের সঙ্গে। যেখানে উত্থান-পতন আর বাঁক-বদলের নানা রঙ আছে। যেখানে চরম ব্যর্থ হওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বিতীয় একটা সুযোগ ঠিকই পাওয়া যায়। টেস্ট ক্রিকেট ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতনও। যারা এর রস নিতে শিখে যান তার টের পান জীবনের এইসব ঐশ্বর্যময় অনুভব ভেতরে কতটা তৃপ্তির আমেজ ছড়িয়ে যায়। এইসব অতুলনীয় অনুভূতি আপনার বেঁচে থাকাকেও সার্থক করে।
বাণিজ্যিকভাবেও আসলে এই সংস্করণে সাফল্যের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। আর কোন খেলায় পাঁচদিন ধরে, এতগুলো বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ নেই। তবে এই বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজের উপর, ক্রিকেটের মানের উপর। ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতন দলগুলোর মুখোমুখি লড়াইয়ে যা একটু বেশি।
এখন দুনিয়া জুড়ে প্রচুর ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বিরামহীন টি-টোয়েন্টি, দুই বছর পর পর বিশ্বকাপ। কাত ঘুরিয়ে আরেক দিকে শুতে গেলেই যেন আরেকটা কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপ চলে আসছে। তবু গত কয়েক বছরে ক্রিকেটের কোন ছবি মনে করতে বললে বেশিরভাগই কোন টেস্ট ম্যাচের শেষ সেশনের টানটান রোমাঞ্চের ছবি উঠে আসবে। হেডিংলি আসবে, ওভাল আসবে।
আইপিএলে কম কীর্তি করেননি মোহাম্মদ সিরাজ, প্রসিধ কৃষ্ণরা। কিন্তু ক্যারিয়ার শেষে তাদের নাম স্মরণীয় করে রাখবে ওভালের সকালই। যেখানে কিনা সাদা পোশাকে লাল বল হাতে উত্তাল তরঙ্গের ঢেউ তুলে ছুটছিলেন তারা।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরর হয়ে এই বছর প্রথমবার আইপিএল জেতার পর বিরাট কোহলি তাই বলেন, 'আপনারা জানেন, আমার খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের কাছে এর মর্যাদা এখনও পাঁচ ধাপ নিচে। আমি টেস্ট ক্রিকেটকে কতটা মূল্যায়ন করি, এবং একে কতটা ভালোবাসি, এটা তারই প্রমাণ। তাই আমি তরুণ ক্রিকেটারদের অনুরোধ করব, তারা যেন এই ফরম্যাটটিকে সম্মানের চোখে দেখে। কারণ আপনি যখন টেস্ট ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করবেন, তখন আপনি বিশ্বের যেকোনো জায়গায় গেলে মানুষ আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে হাত মেলাবে এবং বলবে, "খুব ভালো করেছ, তুমি খেলাটা দারুণ খেলেছ।" তাই আপনি যদি বিশ্ব ক্রিকেটে সম্মান অর্জন করতে চান, তাহলে টেস্ট ক্রিকেটকে বেছে নিন, এতে আপনার মন ও প্রাণ দিয়ে খেলুন।'
এমন একটা ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ স্রেফ এই দলের মধ্যেই আবদ্ধ নয়। এ যেন টেস্ট ক্রিকেটেরই বিজ্ঞাপন, জয়গান।
Comments