যে কারণে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

টিকটক চীন সরকারকে তথ্য পাচার করে এবং এটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি- এমন ধারণা বহু দিন ধরেই দিয়ে আসছে পশ্চিমা দেশগুলোর বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংস্থা। 
যে কারণে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টিকটক নিষিদ্ধের হুমকি দেওয়ার পর তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে নতুন করে আলোচেনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাইডেন বলেছেন, টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশটি সে দেশেরই কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করে না দেয়, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে নিষিদ্ধ করবেন। 

টিকটক চীন সরকারকে তথ্য পাচার করে এবং এটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি- এমন ধারণা বহু দিন ধরেই দিয়ে আসছে পশ্চিমা দেশগুলোর বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংস্থা। 

যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চায়?

২০১৬ সালে চালু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী টিকটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে টিকটকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি, যার মধ্যে ১০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এটির উত্থানের সঙ্গে বিতর্কও বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে, অ্যাপটি ব্যাপকভাবে গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেগুলো চীন সরকারের কাছে পাচার করে। যা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাইটড্যান্স যেহেতু চীনা কোম্পানি, তাই চীনের আইন অনুসারেই কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কোম্পানিটি যেকোনো তথ্য সরকারকে দিতে বাধ্য। এটিই মূল উদ্বেগের বিষয়।  

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ইনফরমেশন সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্টন ডাবুরা বলেন, 'সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যবহারকারীরা জানেও না যে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য বিদেশি একটি সরকার ব্যবহার করতে পারে- এ ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। মানুষ জানলে অবাক হবে যে, তাদের ছোটখাটো বিভিন্ন তথ্য মোবাইল ডিভাইস থেকে চুরি করে সেগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরুপ।'

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের প্রধান কলকাঠি নাড়ছেন মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতারা। তারা মনে করছেন বাইটড্যান্স ব্যবহারকারীর ব্রাউজিং হিস্ট্রি ট্র্যাক করার মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়াতে সহায়তা করতে পারে। টেক্সাস থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলের কংগ্রেস সদস্য মাইকেল ম্যাককল, যিনি আবার হাউজ ফরেন অ্যফেয়ার্স কমিটির সদস্য। যে কমিটি টিকটককে নিষিদ্ধ করার বিল উত্থাপন করেছে। 

ম্যাককল বলেন, 'কোনো ব্যবহারকারী তার ফোনে টিকটক ডাউনলোড করেছেন মানে হলো তিনি চীন সরকারের কাছে তার ব্যক্তিগত তথ্য পাচার করার অনুমতি দিয়েছেন। এটা হচ্ছে গ্রাহকের ফোনের স্পাই বেলুন।'

ডেমোক্রেটিক দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনপ্রণেতারাও এখন টিকটকের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেছেন।  

টিকটক অবশ্য সব সময়ই গ্রাহকের তথ্য চুরি বা পাচারের সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেন, 'যদি জাতীয় নিরাপত্তাই মুখ্য হয়, তাহলে টিকটকের একটি অংশ বিক্রিতে বাধ্য করার মাধ্যমে সেটি সমাধান হবে না। মালিকানা পরিবর্তন হলেই তথ্যের প্রবাহে বা প্রবেশাধিকারে কোনো নতুন বিধিনিষেধ আসবে না। জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যে সেই দেশের নিরাপত্তা সিস্টেম ব্যবহার করা, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করা- যা ইতোমধ্যে আমরা করছি।'

টিকটক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর চাপ বাড়ার প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাও জি চিউ আগামী সপ্তাহে ক্যাপিটল হিলে অ্যাপটির নিরাপত্তা ত্রুটি ও তথ্য পাচার বিষয়ে জবাবদিহি করবেন, যেখানে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক- উভয় দলের আইনপ্রণেতাদের কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। 

যে দেশগুলোতে টিকটক নিষিদ্ধ

কয়েকটি দেশ জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ইতোমধ্যে টিকটক নিষিদ্ধ করেছে বা সে পথে হাঁটছে। 

নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনায় ২০২০ সালে ভারত সরকার সে দেশে টিকটক এবং উইচ্যাট নিষিদ্ধ করেছে। ক্ষতিকর কনটেন্ট আছে, এমন অভিযোগে পাকিস্তান এখন পর্যন্ত অন্তত ৪ বার সাময়িকভাবে টিকটক নিষিদ্ধ করেছে। আর 'যুবকদের ধ্বংস করছে'; এই অভিযোগে আফগানিস্তনের তালেবান সরকার ২০২২ সালে এই অ্যাপটি নিষিদ্ধ করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তাইওয়ান সরকার নিজ নিজ দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের অফিশিয়াল ডিভাইসে টিকটক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে যুক্তরাজ্যের নাম।  

কী প্রভাব পড়তে পারে ব্যবহারকারীদের উপর?

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হলে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে অনেক ব্যবহারকারীই শঙ্কিত, বিশেষ করে যারা টিকটককেই তাদের প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুসারে, টিকটকের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী ব্যবহারকারীরা একটি বিজ্ঞাপনী পোস্টের মাধ্যমে আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন। এরকম একজন ব্যবহারকারী টুইট করেছেন, 'কেউ কি বাইডেন প্রশাসনকে বলবেন যে আমরা অনেকে টিকটককে পেশা হিসেবে নিয়েছি এবং এট নিষিদ্ধ হলে আমাদের আর করার কিছু থাকবে না?'

সম্ভাব্য নিষিদ্ধের ঝুঁকিতে থাকায় অনেক ক্রিয়েটরই তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে পোস্ট করা শুরু করেছেন।  

যুক্তরাষ্ট্রে যদি টিকটক নিষিদ্ধ হয়, তাহলে অনেক কোম্পনির জন্যই বিশাল এক দ্বার উন্মোচিত হবে। টিকটকের ব্যপক জনপ্রিয়তার কারণেই ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম একইরকম 'রিলস' ফিচার চালু করে। গত অক্টোবরে টুইটারের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ছোট আকারের ভিডিও শেয়ারিং সাইট ভাইন আবার ফেরত আনতে চান।  

মালিকানা পরিবর্তন কি টিকটককে নিরাপদ করবে?

কমিটি অন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ইন দ্য ইউএস (সিএফআইইউএস)-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা হ্যারি ব্রডম্যান বলেন, 'মালিকানা বদল একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি যথেষ্ঠ হবে?'

টিকটক গত ২ বছর ধরেই সিএফআইইউএস-এর সঙ্গে এই ইস্যুতে কাজ করছে। টিকটকের প্রধান নির্বাহী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'টিকটকের মার্কিন অংশের মালিকানায় পরিবর্তন আসলেই অ্যাপটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকে হ্রাস পাবে না। টিকটক বরং জানিয়েছে তারা মার্কিন গ্রাহকদের তথ্য সুরক্ষার জন্য বাড়তি ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করবে, যাতে চীন সরকার এই তথ্যে কোনো প্রবেশাধিকার না পায়।'

তবে টিকটক ভাবছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য তারা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওরাকলের সেবা গ্রহণ করবে। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী চিউ বলেন, 'আরও কী কী নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, সে সম্পর্কে আমি খোলামেলা কথা বলতে চাই। আমি এখনো এমন কোনো সমস্যা পাইনি, যেটি এভাবে (ওরাকলকে দিয়ে তথ্য সংরক্ষণ) মোকাবিলা করা যাবে না।'

টিকটক আরও জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিকই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের, যাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাকরক, জেনারেল আটলান্টিক ও সেক্যুয়া ক্যাপিটালের মতো বড় বড় বিনিয়োগকারীও আছেন (যদিও অনেক স্টার্টআপের মতো বাইটড্যান্সের প্রতিষ্ঠাতারাও কোম্পানির মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই রেখেছেন)। 

টিকটকের মালিকানা নিয়ে বতর্ক যুক্তরাষ্ট্র-চীনের দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে এখন। ব্রডম্যান বলেন, 'মালিকানা পরিবর্তন আদৌ কাজে আসবে কি না, নিশ্চিত নই। তবে মার্কিন সরকার দেশটির নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটি নিয়ে আরও বড় বিতর্কের সৃষ্টি হবে।'

সূত্র: টাইম.কম

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments