বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিতর্ক, যা বলছে আইএমএফ

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরির পর শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা। আলোচনা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে প্রতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে অফিসিয়াল পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও, মানুষের জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরির পর শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা। আলোচনা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে প্রতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে অফিসিয়াল পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও, মানুষের জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই।

সবার একটাই প্রশ্ন, বর্তমানে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ঠিক কত।

বাংলাদেশে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইএমএফের সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের সংজ্ঞা বিবেচনায় বাংলাদেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ এখন প্রায় সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার।' 

কিন্তু গ্রস রিজার্ভ বা মোট রিজার্ভ আসলে কী? আইএমএফের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) অনুযায়ী এটি হলো রিজার্ভ সম্পদের পরিমাণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আস্থার সঙ্গে এটা অনুসরণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো তা গ্রহণ করেনি।

রিজার্ভ সম্পদের মধ্যে থাকবে, স্বর্ণ, নগদ মার্কিন ডলার, বন্ড ও ট্রেজারি বিল, ঋণমুক্ত থাকা সাপেক্ষে আইএমএফের রিজার্ভ অবস্থান, আন্তর্জাতিক রিজার্ভ সম্পদ, আইএমএফের হিসাবে যা আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিবর্তন করা যায় এবং আরও কিছু বিষয়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভের হিসাব অন্যান্য কিছু বিষয় দ্বারা নির্ধারণ করা হয় এবং এ কারণে রিজার্ভের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজকের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার এবং এতে ইডিএফসহ আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে।'

আমাদের গ্রস রিজার্ভের হিসাবের মধ্যে আছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ৭ বিলিয়ন ডলার, গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের ২০০ মিলিয়ন ডলার, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার, গ্যারান্টিসহ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নেওয়া ঋণের ৪৮০ মিলিয়ন ডলার, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) কাছে জমা থাকা অর্থ, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারের কারেন্সি সোয়াপ, ৫২৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো ঋণের বিপরীতে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ৭৭ মিলিয়ন ইউরো।

আইএমএফের স্টাফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইএমএফের ম্যানুয়াল অনুযায়ী এগুলো রিজার্ভ সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এসবের মাধ্যমে প্রায় ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের হিসাব দেখানো হয়েছে।'

এ কারণে, সদ্য সমাপ্ত আইএমএফ স্টাফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে রিজার্ভ হিসাবের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।

বৈঠকে আইএমএফ মিশন বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিল বলে এতে অংশ নেওয়া অনেকের কাছ থেকে জানা গেছে।

ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, রিজার্ভ সম্পদকে নিঃশর্ত থাকতে হবে, এর যথেষ্ট লিকুইডিটি থাকা উচিত যেন ন্যূনতম সময়ে ও খরচে তা বৈদেশিক মুদ্রার (নগদ) বিপরীতে সম্পদ বেচাকেনা করা যায় এবং তা সম্পদের মূল্যকে অযথা প্রভাবিত করবে না।

গ্রস রিজার্ভ 'বিভ্রান্তিকর' হওয়ায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য চাহিদা মেটাতে আইএমএফ মিশন নেট রিজার্ভের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির আহ্বান জানিয়েছে।

এ অবস্থায় গ্রস রিজার্ভ থেকে স্বল্পমেয়াদে বের হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দিয়ে নেট রিজার্ভের হিসাব সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য উপযোগী।

স্বল্পমেয়াদে বের হতে পারে এমন বৈদেশিক মুদ্রা বলতে ভবিষ্যৎ আমদানি বিল এবং ঋণ পরিশোধের অর্থকে বোঝানো হয়।

যেসব দেশের উন্মুক্ত মূলধন কম, তাদের আমদানি বিল প্রায়ই হিসাবে দেখানো হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে দেশটি অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থায় কত সময় আমদানি চালিয়ে যেতে পারবে।

আইএমএফের মতে, সাধারণত ৩ মাসের আমদানি মেটাতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়।

১৫ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ গত ৯ নভেম্বর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের এখনো ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাসের আমদানি বিল মেটানোর সক্ষমতা আছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশের গড় মাসিক আমদানি বিল সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ যেভাবে হিসাব করছে, মোট রিজার্ভ সেভাবে ধরলেও বর্তমানে ৪ মাসের বেশি সময় আমদানি চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আছে আমাদের।' 

'এর সঙ্গে ইডিএফ ও অন্যান্য বিষয় যোগ করলে সাড়ে ৫ মাসের আমদানি খরচ চালানো যাবে,' বলেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ গণনার ক্ষেত্রে আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণে কোনো সমস্যা নেই এবং আগামী জানুয়ারির প্রথম দিকে বাংলাদেশ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী হিসাব শুরুর পরিকল্পনা করছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইডিএফের অর্থ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হবে। তাই আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের প্রতিবেদন তৈরি করতে সমস্যা হবে না।'

 

Comments