অর্থপাচারের চাহিদা কমায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স আয়ে রেকর্ড

গত মার্চে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড তিন দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি।
মূলত বিদেশে অর্থ পাচারের চাহিদা কমা, বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ও ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের বাড়তি টাকা দেশে পাঠানোয় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে।
দেশ একদিকে যখন রিজার্ভ কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ও অন্তর্বর্তী সরকার যখন সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত তখন রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ অনেকটা স্বস্তি দিচ্ছে। গত বছরের আগস্ট থেকে রেমিট্যান্স আয় ক্রমাগত বাড়তে থাকায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি পাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে মূল অবদান প্রবাসীদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—এর আগে মাসভিত্তিক রেকর্ড ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। তখন রেমিট্যান্স এসেছিল দুই দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। গত মাসে তা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
এদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
'বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসায় এই প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে,' উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট পাচারকারীরা পলিয়ে থাকায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো কমেছে।'
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কিত শ্বেতপত্রের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, 'ধারণা করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার।'
'হুন্ডি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে।'
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াও বৈধ পথে বাড়তি রেমিট্যান্স আসার আরেক কারণ বলে মনে করেন তিনি। তবে এর প্রভাব সামান্য।
'রেমিট্যান্স সাধারণত ডলারে পাঠানো হয়। তাই মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত শক্তিশালী হলে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম বেড়ে যায়। তবে শুধু এই ঘটনার জন্য সম্প্রতি রেমিট্যান্স বেড়েছে বলে মনে হয় না।'
করোনা মহামারির পর দেশে টাকা পাঠানো প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় ২৯ লাখ। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাময়িকভাবে রেমিট্যান্স আসা কমেছিল। তবে ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের সুযোগ দেওয়ায় ও হুন্ডির ওপর নির্ভরতা কমে যাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহে এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলো দ্রুত-নিরাপদে বিস্তৃত পরিসরে সেবা দেওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে—২০১৭ সালে জনশক্তি রপ্তানি ১০ লাখ ছাড়িয়েছিল। পরের চার বছরে তা কমে বার্ষিক দুই থেকে সাত লাখ হয়।
২০২২ সালে তা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তা আরও বেড়ে ২৩ লাখ হয়।
জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও ২০২২ ও ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স আসা কমে যায়। ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বছরের শেষের দিকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসা বাড়তে থাকে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮০ দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে দুই দশমিক চার বিলিয়ন ডলার হয়। গত অক্টোবরে হয় দুই দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার, নভেম্বরে দুই দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, ডিসেম্বরে দুই দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, জানুয়ারিতে দুই দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার ও ফেব্রুয়ারিতে দুই দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
এই প্রবৃদ্ধি দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ কমিয়েছে। ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশনে তারল্য বেড়ে যাওয়ায় বকেয়া বিল পরিশোধ করা সহজ হয়। আমদানি ও রিজার্ভ শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তা ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিন বছরে টাকার মান ৪২ শতাংশ কমে যায়।
গতকাল ৬ এপ্রিল পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম৬ হিসাব পদ্ধতিতে রিজার্ভ ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেমিট্যান্স বৃদ্ধি মুদ্রাবাজারকে বেশ স্থিতিশীল করেছে। এটি দেশকে সময়মতো অনেক বিদেশি খরচ পরিশোধে সক্ষম করেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে।'
উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, 'সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বেড়েছে বলেই রেমিট্যান্স বাড়ছে।'
'মানুষ যখন সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, তখন তারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে শান্তি পান। তাই সরকার স্থিতিশীল হলে রেমিট্যান্স আসা বাড়বে।'
তার ভাষ্য, ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স আনতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা বাড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদুল ফিতরের আগে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে। অর্থপাচার কমে যাওয়ায় হুন্ডি কমেছে। তাই আরও বেশি সংখ্যক প্রবাসী ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে ঝুঁকছেন।'
'ব্যাংক ও হুন্ডির মধ্যে বিনিময় হারের ব্যবধান কমে যাওয়ায় প্রবাসীরা ব্যাংক ব্যবহারে আরও আগ্রহী হচ্ছেন।'
রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি বিদেশি ঋণের বোঝা কমাতে সহায়তা করেছে। খোলা বাজার ও ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে পার্থক্য কম থাকায় ব্যাংকের ওপর আস্থা বেড়েছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে অবদান রাখছে।
এর ফলে, চলতি হিসাবের ঘাটতি চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারির মধ্যে ৫৫২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে তুলনায় তা কমেছে ৮৭ শতাংশ।
Comments