মুড়িমাখায় জিলাপি: হ্যাঁ নাকি না?

বাংলাদেশে রমজান মাস হলো বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির সংমিশ্রণ। আজানের ধ্বনি, ফুটন্ত তেলে পেঁয়াজু ভাজার শব্দ, রাস্তার ধারের দোকান থেকে ভেসে আসা দোকানির 'ভাই গরম জিলাপি' চিৎকার; এই সবকিছু মিলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তার ভেতরে এক ধরনের সম্প্রীতি রয়েছে।

এখানেই আসে মুড়ি মাখানোর প্রসঙ্গ। আলুর চপ বা বেগুনির ভিড়ে মুড়ি মাখানো ইফতারের টেবিলে কিছুটা নীরবেই থাকে। তবে এটাই হলো ইফতারেরসবচেয়ে সেরা খাবার। একটি বড় পাত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে মুড়ি মিলে তৈরি করা হয় মুড়ি মাখা। আর এই মুড়ি মাখায় জিলাপি মেশানো হবে কি না তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় ডাইনিং টেবিল থেকে ফেসবুকের কমেন্ট সেকশন অবধি।

মুড়ি মাখার উৎপত্তি কোথায়?

মুড়ি শতাব্দী প্রাচীন একটি খাবার। চাল দিয়ে তৈরি খাবারটি এটি বেশ হালকা হওয়ায় সহজেই হজম হয়। এটি বেশ ঝামেলামুক্ত হালকা নাশতা হিসেবে জনপ্রিয়। ইফতারে সাধারণত সরিষার তেল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, সামান্য লবণ আর ছোলা মিশিয়ে মুড়ি মাখানো হয়। এক্ষেত্রে ওয়াইল্ড কার্ড কী জানেন? একটি জিলাপিকে কয়েক টুকরো করে সেই মুড়ি মাখার মধ্যে ফেলে দেওয়া!

জিলাপি হলো মোঘল আমলের খাবার। যা এই উপমহাদেশে এসেছিল পারস্যের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে, যারা আমাদের মতোই ডুবো তেলে ভাজা মিষ্টান্নপ্রেমী ছিলেন।

এবার বলি পেঁয়াজু আর বেগুনি কোথা থেকে এল। সরাসরি বাংলার রাস্তা থেকে প্লেটে উঠেছে এরা। বাংলাদেশে ডুবো তেলে ভাজা যেকোনো খাবারকেই খুব স্বাভাবিকভাবে আপন করে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। এদের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে। অন্যদিকে আলুর চপের শেকড় পর্তুগীজ প্রভাবিত ভারতীয় খাবারে নিহিত।  কিন্তু এই খাবারগুলোর কোনোটিই মুড়ি মাখার মধ্যে জিলাপির মিশ্রণের মতো বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারেনি।

জিলাপি প্রেমিকদের মতে: নোনতা-মিষ্টির সংমিশ্রণ স্বাদে সেরা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাহীনের জিলাপি আসক্তি রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ের।

মুড়ি মাখার সঙ্গে জিলাপির সংমিশ্রণের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বললেন, 'অনেক মানুষ আইসক্রিমে ডুবিয়ে ফ্রেঞ্চফ্রাই খায়। তাহলে আমি কেন মুড়িতে জিলাপি মেশাতে পারব না? এটাকে বলে স্বাদের নতুনত্ব। যারা মুড়ি মাখায় জিলাপি অপছন্দ করে তারা প্রকৃত স্বাদ কী সেটাই জানে না। তাদের অর্ধেকের কাছেই টমেটো সস খাবারকে সুস্বাদু করার একটি উপকরণ।'

তার যুক্তি হলো, বৈপরীত্ব সবকিছুকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। মুচমুচে মুড়ির সঙ্গে সরিষার তেলের ঝাঁজ, কাঁচা মরিচের মৃদু স্বাদ-সবকিছুরই ভারসাম্য প্রয়োজন। আর সেই ভারসাম্য আনতে আঠালো কিন্তু মচমচে মিষ্টি জিলাপির চেয়ে ভালো আর কীই বা হতে পারে?

তার যুক্তি খারাপ না। মিষ্টি আর নোনতা স্বাদের মিশ্রণ আসলেই সুস্বাদু হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন সল্টেড ক্যারামেল ফ্লেভার, মধু আর পনিরের সংমিশ্রণ এমনকি আমাদের সবার প্রিয় দই-মিষ্টির যে মেলবন্ধন, সেটাও কিন্তু অনেকটা বৈপরীত্যের মিশ্রণই।

কথা হয় হোম মেকার মা মুক্তার সঙ্গে। যিনি বাড়িতে রীতিমতো টেবিলভর্তি ইফতারের আয়োজন করেন। তিনিও মুড়ি মাখার সঙ্গে জিলাপির মিশ্রণের পক্ষের মানুষ।

প্রসঙ্গ উঠতেই একটু যেন ক্ষেপেই গেলেন মুক্তা।

তিনি বলেন, 'আমি রান্নাঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে ইফতার তৈরি করি। এখন আপনি বলছেন জিলাপি আলাদা পরিবেশন করতে হবে? না ধন্যবাদ, জিলাপি মুড়ির সঙ্গেই মাখানো হবে। আর এসব তথাকথিত নিয়ম কারা বানায়? মুড়ি মাখানো পুলিশ?'

তার যুক্তিও বেশ বাস্তবসম্মত। ইফতারের সময় কত কাজ থাকে, কত প্লেট ভর্তি করে খাবার দিতে হয়, কতকিছুর দিকে নজর রাখতে হয়। মুড়ি মাখার মধ্যে জিলাপি দিলেই তো কাজ সহজ হয়ে যায়, তাহলে এটা করতে সমস্যা কোথায়?

মুড়ি-জিলাপির বিরোধীরা বলেন: ঐতিহ্যবাহী স্বাদ নষ্ট করবেন না

এতক্ষণ তো জিলাপিপ্রেমীদের কথা বললাম। এবার ভিন্নমতের কথাও শুনি।

চাকরিজীবী শেফালি খুব কম দিনই ইফতারের আগে বাড়ি ফিরতে পারেন। তাই জিলাপি সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সময় পান না অথবা এত ধৈর্য তার নেই।

শেফালি বলেন, 'মুড়ি মাখানো খুব হালকা একটি নাশতা হওয়ার কথা। অন্যদিকে জিলাপি তো রীতিমতো চিনির তৈরি বোমা। দুটো জিনিসকে মেশালে অকারণ স্বাদতন্ত্রের ওপর অত্যাচার করা হয়।'

তার এই যুক্তির পক্ষে আছে বিজ্ঞান। মুড়ি তার স্বভাবগতভাবে মচমচে। কিন্তু এর মধ্যে ভেজা-আঠালো জিলাপি মেশালে খুব দ্রুত মুড়ি মাখা খাবারটিতে মুড়িই নরম হয়ে গোটা জিনিসটা জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়। এটা অনেকটা চায়ের মধ্যে দীর্ঘসময় বিস্কুট ডুবিয়ে রাখার মতো। মুড়ির এই নরম হয়ে যাওয়া অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।

এরপর কথা বলি ঐহিত্য রক্ষার বিষয়ে খুবই কঠোর কাসেম দাদুর সঙ্গে।

তিনি বলেন, 'আমাদের সময়ে মুড়ি মাখানো বলতে বোঝাত মুড়ি, লবণ, পেঁয়াজ আর সরিষার তেলের মিশ্রণকে। বর্তমান প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। এরপর আর কী মেশাবে? মুড়ি মাখানোতে চকলেট সিরাপ দেবে? ঝালমুড়িকে ডিকনস্ট্রাকচার্ড পাফড রাইস বলে পরিচয় দিয়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি করবে?'

তার কাছে মুড়ি মাখায় জিলাপি মেশার বিষয়টি নীতিগত ব্যাপার!

জিলাপি ছাড়াই যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যবাহী মুড়ি মাখানো টিকে আছে। তার মতে, এটা অনেকটা বিরিয়ানির ওপর শরবত ঢালার মতো অযৌক্তিক বিষয়। কিছু জিনিস একটি আরেকটি সঙ্গে মেশানোর জন্য তৈরি হয় না।

তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? জিলাপি কি মুড়ি মাখার সঙ্গে মিশতে পারে?

উত্তরটি হবে হ্যাঁ এবং না, দুটোই। কারণ দিনশেষে খাবার পুরোপুরি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। একজনের পছন্দের ইফতারের প্লেট আরেকজনের কাছে ভয়ংকর মনে হতে পারে। হতে পারে আপনি এমন কেউ যার কাছে মিষ্টি আর নোনতা স্বাদের মিশ্রণ বা এই ধরনের বৈপরীত্য ভালো লাগে। কিংবা আপনি এমন কেউ যে, কোনো খাবারের মূল স্বাদটিই ভালোবাসেন বা ঐহিত্যকে নষ্ট করতে চান না।

তবে উত্তর যাই হোক না কেন, আমরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করব যে রমজান মাস যতটাই খাবারের ততটাই মিলেমিশে খাবার গ্রহণের মাস। আপনি জিলাপিপ্রেমী বা বিরোধী যাই হন না কেন, ইফতারের টেবিলে আপনার জন্য একটি আসন বরাদ্দ থাকবে। 

শুধু একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন। কাউকে জিজ্ঞেস না করে তার মুড়ি মাখানোর মধ্যে জিলাপি দিয়ে দেবেন না। আর যদি দিয়েই দেন, তাহলে খাবার নিয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতও থাকতে হবে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

6h ago