শ্রদ্ধা

আড়ালের বুদ্ধিজীবী সৈয়দ মুজতবা আলী

একজন রম্যলেখক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। এর পেছনে যে ঔপনিবেশিক ভূতের আছর আছে তা স্পষ্টত। কেননা রম্য তকমা থাকলে ভাঁড় বলেও চালিয়ে দেয়া যায়। যেটা চাউরও রয়েছে বাঙাল মুলুকে। অথচ তিনি ভাঁড় নন, নন কেবলই একজন রম্যলেখক ও ভ্রমণসাহিত্যিক। আক্ষরিক অর্থে তিনি বুদ্ধিজীবী, সত্যের প্রশ্নে-দেশ ও জাতির প্রয়োজনে। যার লেখায় জারি রয়েছে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা ও সকল কোশেশ। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

একজন রম্যলেখক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। এর পেছনে যে ঔপনিবেশিক ভূতের আছর আছে তা স্পষ্টত। কেননা রম্য তকমা থাকলে ভাঁড় বলেও চালিয়ে দেয়া যায়। যেটা চাউরও রয়েছে বাঙাল মুলুকে। অথচ তিনি ভাঁড় নন, নন কেবলই একজন রম্যলেখক ও ভ্রমণসাহিত্যিক। আক্ষরিক অর্থে তিনি বুদ্ধিজীবী, সত্যের প্রশ্নে-দেশ ও জাতির প্রয়োজনে। যার লেখায় জারি রয়েছে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা ও সকল কোশেশ। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী।

তার সমকালের বিরলপ্রজ এক ব্যক্তিত্ব যার বিশ্ববীক্ষা তুলনারহিত, যার দেশপ্রেম ও মানুষের কল্যাণ ভাবনা এবং সময় ও সভ্যতার প্রগতিশীলতায় অবদান অসামান্য। যিনি অবলীলায় বলতে পারেন সত্যজ্ঞান করা যেকোনো কথা। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র শতবর্ষের অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি কোনো প্রকার ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করেই বলেছিলেন, বিশ্বভারতী কবি রবীন্দ্রনাথকে নয়, টেগোর রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন।

দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত হয় খণ্ডিত ও স্বাধীন। বিশ্ব ভূগোলে আবির্ভূত হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি হয় মুসলমানের দেশ, অন্যটি হিন্দুদের। পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশে সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও দেশান্তর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালি মুসলমানেরা বন্যার পানির মতো উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে চলে আসে পূর্ববঙ্গে। একই অবস্থা হয় পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের-তারাও বাধ্য হয় উদ্বাস্তুর জীবন, পাড়ি দেয় পশ্চিমবঙ্গে। রাজনীতিবিদদের ভ্রম ও ক্ষমতালিপ্সা, ব্রিটিশের ধুরন্ধরতা কিংবা দীর্ঘ সময়ে ধরে চলে আসা হিন্দু, মুসলমানের সম্প্রদায়গত অনাস্থা, অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং স্বার্থান্ধতা যাই-ই বলা হোকনা কেন, দেশভাগ রুঢ় এক বাস্তবতা। 

বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের যাওয়া ও আসার বাঁধভাঙ্গা স্রোতের পরও দুই জায়গাতেই কিছু মানুষ থেকে যায়। সেটা শুধু প্রান্তিকেই নয় সমাজের উপরের সারিতেও। প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা চাইলেই অভিবাসী হতে পারতো, অথচ চাইলেন না। উনাদেরকে প্রয়োজনও ছিল, কেননা দেশান্তরের কারণে অনেক জায়গায় বড়ো রকমের শূন্যতা তৈরি হয়। কেন চাইলেন না, সেটা এখন মস্তোবড়ো এক প্রহেলিকা। কারণ এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এখন আর পাওয়ার নয়। যারা চাইলেন না, তাদেরই একজন সৈয়দ মুজতবা আলী। 

অথচ আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। উনারা কি এই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি? পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানের এরূপ সম্পৃক্ততায় প্রথম দিন থেকেই কী দ্বিধান্বিত ছিলেন। নাকি পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিচ্ছিলেন। কোনো আশা কি জিইয়ে ছিল তাদের মনে? লক্ষণীয়, ওই সময়ে তারা কলকাতায় অবস্থান করলেও পূর্ববঙ্গের ন্যায্য স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে ছিলেন সোচ্চার। আমরা এই ধারায় আরও একজন মানুষকে স্মরণ করতে পারি তিনি হলেন আবুল মনসুর আহমদ।

যিনি পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেন ১৯৫০ সালে, দেশ ভাগ পরবর্তীতে দুই বছরেরও বেশি সময় পর। তিনি তখন ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক। ইত্তেহাদ তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে জনমত গঠন ও ন্যায্যতার বিষয়ে সর্বমহলে ওয়াকিবহাল করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদও অব্যাহত রেখেছিলেন এ বিষয়ক লেখালেখি।

সৈয়দ মুজতবা আলীও এ সময় পালন করেন কৌতূহলোদ্দীপক এক ভূমিকা। কলকাতায় বসেই তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে গোটা একটা বই লিখেছিলেন, 'পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামে। তিনি অবশ্য ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গে ফেরেন এবং বিশ্রী ও বেদনাহত এক অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে যান। বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ফিরে যাওয়ায় পদটি শূন্য হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী ওই পদে যোগদান করেন। কিন্তু কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক লেখার কারণে পড়তে হয় পাকিস্তান সরকারের রোষানলে। ওই ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন মমতাজুর রহমান তরফদার, তিনিও শিকার হন সরকারি হেনস্থার। অভিযোগ ওঠে এক লেখায় সরকারের একজন মন্ত্রীকে প্রচ্ছন্নভাবে অপমান করা হয়েছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি ওই ম্যাগাজিনে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে তার মেজভাই বগুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুর্তাজা আলীকেও যুক্ত করা হয়। 

উপর মহল থেকে এ ব্যাপারে উনার সঙ্গে বাহাস হলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন তার ভাইয়ের চাকরির অভাব নেই, উনি ১৯৩২ সালে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট করেছেন। এখানে তিনি চাকরির জন্য আসেননি, এসেছেন দেশপ্রেম থেকে। উনি চাইলেই যে কোনো জায়গায় এর চেয়ে বড়ো চাকরি পেয়ে যাবেন। মেজভাইয়ের কাছে এই বাহাস ও বয়ান শোনার পরে সত্যি সৈয়দ মুজতবা আলী কলকাতা চলে যান এবং মেজভাইয়ের কথামতো বড়ো চাকরিও পেয়ে যান। পাকিস্তান সরকার সৈয়দ মুর্তাজা আলীকে অন্যত্র বদলি করেন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর এই আসা এবং যাওয়াকে দেখতে হবে বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে। তিনি যদি কেবলই একজন ভাঁড় লেখক হতেন তাহলে কোনোমতে-আপস করে থেকে যেতেন। কিন্তু রম্য এই লেখকের সমস্ত লেখালেখি ও যাপিত জীবনের ভেতর বসবাস করতো একজন বুদ্ধিজীবীর সত্তা। যে বুদ্ধিজীবী যে কোনো প্রশ্নে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো অবস্থানে তার শিরদাঁড়া সোজা রাখার কাজটাই করেন। কারণ বুদ্ধিজীবীর ধর্ম এটাই।

সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মেছিলেন সিলেটের করিমগঞ্জে ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। মারা যান ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ১৯৭৪ এর ১১ ফেব্রুয়ারি। লেখাপড়া ও চাকরিসূত্রে বহু জায়গার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। ১৪টা ভাষা জানতেন। বিশ্ববীক্ষা ছিল তার মননে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাকে পরিণত করেছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ এক ব্যক্তিত্বে। বিশ্ববীক্ষায় অনন্য এই ব্যক্তিত্বের শৈশব ও কৈশোরের সময়কে উহ্য করলে আমরা দেখতে পায় জন্মস্থান বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই বললেই হয়। এমনকি জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য টানা যে সময় পাড়ি দিয়েছেন, পরিণত বয়সের ততোটুকু সময় ব্যয়িত হয়নি এখানে। কিন্তু তার মনন জুড়ে ছিল এই জল-হাওয়ার মানুষেরা। লেখালেখিতে নানানভাবে রেখে গেছেন সেই প্রমাণ। একজন বুদ্ধিজীবীর কাছে যে ভূমিকা প্রত্যাশিত তার সময় ও সমাজের, সেই ভূমিকা পালনে তিনি ছিলেন সততই উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ। 

যার দৃষ্টান্ত আমরা পাই সদর্থক অর্থেই তার গুণগ্রাহী ও শিষ্য গোলাম মোস্তাকীমের লেখা বই, 'সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ' এ। লেখকের সঙ্গে পরিচয় পর্বটা মনে রাখার মতো। প্রথম দিনের পরিচয়ে 'মুস্তকীম' রীতিমতো অপমানিত হয়। ঘাড় ধরে না হলেও রুঢ় আচরণে ও কর্কশ ভাষায় মুহূর্তে সৈয়দ মুজতবা আলীর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয় মোস্তাকীমকে। সময়ের কী মধুর প্রতিশোধ। এই মোস্তাকীমই হয়ে ওঠে লেখকের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। এমনকি কখনো কখনো স্ত্রী রাবেয়া আলী, পুত্রদ্বয় ফিরোজ-কবীরের চেয়েও। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে কলকাতায় যে পরিচয় তাতে আর কোনোপ্রকার ভাটা পড়েনি। স্বাধীন দেশেও অব্যাহত থাকে এই গুরু-কৃত্য। এমনকি মোস্তাকীমের হাতেই মারা যান সৈয়দ মুজতবা আলী।

গোলাম মোস্তাকীম এর সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ

সক্রেটিস বেঁচে আছেন প্লেটোর বয়ানে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ও লিখে যাননি কিছুই। এমনকি হিউয়েন সাংয়ের যে লেখায় আবিষ্কার করি প্রাচীন বাংলাকে। সেটাই মুখে শোনা গল্প থেকেই লিখেছেন তার দুই শিষ্য। গোলাম মোস্তাকীমও  সৈয়দ মুজতবা আলীর ক্ষেত্রে পালন করেছেন একই ভূমিকা। লেখক মুজতবা আলীর অন্য এক পরিচয় মূর্ত হয়েছে মোস্তাকীম এর লেখায়। 'যদ্যপি আমার গুরু'র মতো দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক বই। একজন মানুষের জানাশোনার ব্যাপ্তি কেমন হতে পারে। কতো কিছু এবং কতো মানুষ সম্পর্কে থাকতে পারে পরিষ্কার ধারণা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সেসবের হদিশ মেলে মোস্তাকীমের তরফে মুজতবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গ্যোটে থেকে শুরু করে শেলী, কীটস শেক্সপীয়র, আবু সায়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুব এমনকি হিটলার, কিসিঞ্জার- এককথায় ধর্ম প্রণেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, সমাজসেবক সকলের চারিত্র্যকাঠামো ধরা পড়েছে এখানে-যার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতার্থে উদ্ভাসিত হয়েছে মুজতবার অবলোকন শক্তির অনন্য এক অধ্যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর বয়ানে আমরা অনেককিছু কেবল জানতেই পারি না। তৈরি হয় বোঝাপড়ার শক্তি, যা খাসলত নির্মাণে পালন করে প্রভূত ভূমিকা। একজন লেখকের অন্তর্দৃষ্টি কতোটা প্রখর ও শাণিত হলে এভাবে দেখা যায় তার মূর্তরূপ খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। 

আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের দুঃখ বেদনার অনেকখানি অজানা দিক। আমরা জানি স্ত্রী বিয়োগে তিনি ব্যথিত ছিলেন। কন্যাদেরকে প্রাণের অধিক ভালবাসতেন কিন্তু তাদেরকে সুখী দেখার সৌভাগ্য হয়নি। নোবেল পুরস্কারের অর্থে সাধারণ মানুষের কল্যাণে তৈরি করেছিলেন কো অপারেটিভ ব্যাংক। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাক্রম শুরুর লক্ষ্যে স্ত্রীর গয়না বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জানা ছিল না শেষ জীবনে অর্থ সংস্থানের জন্য নিজের হাত ঘড়িটাও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন-সাধারণে জ্ঞাত জমিদার রবীন্দ্রনাথ।

সৈয়দ মুজতবা আলী কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ বিদেশ। যদিও তার ছিল পাখির স্বভাব। দিনশেষে সব পাখি যেমন নীড়ে ফেরে, তিনি স্বশরীরের নীড়ে না ফিরলেও তার মন নীড়ে ফিরতো ঠিকই, প্রাত্যহিক ব্যস্ততা শেষে। এসবের সাক্ষ্য দেয় গোলাম মোস্তাকীম এর বই 'প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ'। ভাই অন্ত প্রাণ ছিল, ভাইয়েরা যেমন তাকে ভালবাসতেন, তিনিও ততোধিক। ভাইদের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও ছিল গভীরতর সম্পর্ক। তার প্রমাণ মেলে যখন তিনি জীবনের প্রথম বই উৎসর্গ করেন বড়ো ভাইয়ের বড় মেয়ে জাহানারাকে। যিনি স্বামী-সন্তানসহ অকালে প্রয়াত হয়েছিলেন।

স্ত্রী-কন্যার প্রতি কেবল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেননি, এসবের ঊর্ধ্বে বন্ধুও হয়ে উঠেছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা মনে পড়লেই আমাদের মনে হয় তার অনবদ্য সৃষ্টি 'পণ্ডিতমশাই' গল্পের কথা। পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্তির সুবাদে এই গল্পের সঙ্গে তখন নাম্বারপ্রাপ্তির বোঝাপড়া। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে যখন এই গল্প পাঠ করা হয় তখন গল্পের শক্তি সম্পর্কে আমরা যেন নতুন পাঠ খুঁজে পাই। ছোটবেলায় আমাদের জানানো হয়েছে এটা একটা রম্য গল্প। কিন্তু আদতে কি তাই! ছোট পরিসরের একটা গল্পে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও তার চালচিত্র, সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল হকিকত, পরিবর্তনের ধাক্কায় পণ্ডিতমশাইদের দূরাবস্থা, শিক্ষার প্রতি সরকারের নেক নজরের স্বরূপ- এক কথায় সবকিছু এমন অনবদ্য ভাষায় উঠে এসেছে তা যেন শুধু সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো বুদ্ধিজীবীর কলমেই প্রস্ফুটনের ক্ষমতা রাখে।

পণ্ডিতমশাই গল্পে সারাজীবন উদোম থাকা পণ্ডিত গেঞ্জি পরার কারণে যেরূপ হাস্যরসের সৃষ্টি হয় এবং সেই হাস্যরস গল্পের শেষাশেষি যেভাবে অনুক্ত হাহাকারে পরিণত হয় তা এককথায় অনবদ্য। পণ্ডিতমশাই মাসে বেতন পান ২৫ টাকা। লাটসাহেবের তিন পা ওয়ালা কুকুরের পেছনে প্রতি মাসে খরচ ৭৫ টাকা। পণ্ডিতমশাইয়ের জিজ্ঞাসা , ''অপিচ আমি, ব্রাক্ষ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাক্ষ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক'টা ঠ্যাঙের সমান? … মূর্খের মতো একবার পণ্ডিত মশায়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে- কেউ বাদ যায়নি- পণ্ডিতমশাই আত্ম অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে। পণ্ডিতমশাই যেন উত্তরের প্রতীক্ষায় বসেই আছেন। সেই জগদ্দল নিস্তব্ধতা ভেঙে কতক্ষণ পরে ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজেছিল আমার হিসেব নেই। নিস্তব্ধতার নিপীড়নস্মৃতি আমার মন থেকে কখনো মুছে যাবে না। 'নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়' `Silence is golden' যে  মূর্খ বলেছে তাকে যেন মরার পূর্বে একবার একলা একলি পাই।''

রাষ্ট্র ও সমাজের সাপেক্ষে একজন ব্যক্তির অবস্থান কেমন ছিল এই গল্প কেবল তার আয়না নয়- একজন বুদ্ধিজীবীর প্রশ্ন করার শক্তিও হয়েছে হাজির-নাজির। গল্পের শেষাশেষি 'নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়'তার মধ্যে দিয়ে দিগম্বর হয়েছে ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্র হলেও তার নপুংশকতার স্বরূপ। এখানেই আর দশজন রম্য লেখক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ সাহিত্যিকের সঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর পার্থক্য, একজন ভাঁড় আর বুদ্ধিজীবীর তফাৎ।

সৈয়দ মুজতবা আলীর বিশিষ্টতা ও সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো তিনি কেবল স্পষ্টবাদী, সাহসী ও রসবোধ সম্পন্ন একজন লেখক-সাহিত্যিক ছিলেন না একই সঙ্গে বিশ্ববীক্ষায়-তীক্ষ্ণধী বিশ্লেষণে-সুক্ষ্ণ মূল্যায়নে অনন্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার বয়ান কেবলই বয়ান নয়, তার গল্প কেবলই গল্প নয়। এসবের অধিক কিছু। যেখানে সময় ঘটনা ও ব্যক্তির সুরতহাল হয় নির্মোহ এক জ্ঞানকাণ্ডে। সেখানে একজন ভাঁড় কিংবা রম্যলেখক নন হাজির হন অনন্য এক বুদ্ধিজীবী। যিনি অন্যের চশমায় নয়-নিজের চশমায় দেখেছেন, জীবনভর অন্বেষণ করেছেন আপন ভূগোল।

Comments