রেলের রাজধানী পঞ্চগড়!

সম্প্রতি প্রকাশিত জনশুমারি অনুযায়ী পঞ্চগড়ে প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার মানুষের বসবাস, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার দশমিক ৭১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।

সম্প্রতি প্রকাশিত জনশুমারি অনুযায়ী পঞ্চগড়ে প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার মানুষের বসবাস, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার দশমিক ৭১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।

তবে রেল পরিষেবার ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে উত্তর অংশের এই জেলাটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ মুহূর্তে ঢাকা থেকে ৩টিসহ মোট ৫টি আন্তঃনগর ট্রেন পঞ্চগড় পর্যন্ত চলাচল করে, যা বিভাগীয় সদর দপ্তর ছাড়া সব জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ।

জেলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের অগ্রাধিকার পেতে শুরু করেছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের ১ মাস আগে পর্যন্ত জেলাটিতে কোনো আন্তঃনগর ট্রেন ছিল না। সেই বছরের নভেম্বরে ঢাকা থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত চলা ২টি আন্তনগর ট্রেনের গন্তব্য পঞ্চগড় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়।

পঞ্চগড়ের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম সুজন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর জেলার রেল পরিষেবার কলেবর ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গত সাড়ে ৩ বছরে রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে ৬টি আন্তনগর ট্রেন ও ১টি আন্তদেশীয় ট্রেন। পঞ্চগড় ৬টি আন্তনগর ট্রেনের মধ্যে ২টি পেয়েছে এবং আরও ১টি আন্তনগর ট্রেন সেবা এ জেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব সূত্র জানায়, মন্ত্রী তার নিজ জেলায় বাড়তি রেল সুবিধা চালু করতে গিয়ে অন্যান্য জেলাকে বঞ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে এমনকি অন্য একটি ট্রেন থেকে নতুন রেক সরিয়ে এনে পঞ্চগড়মুখী ট্রেনের সঙ্গে তা যুক্ত করেছে।

'রেক' হচ্ছে কয়েকটি কোচের সমন্বয়ে গঠিত অবকাঠামো, যেটি ইঞ্জিন ছাড়া ট্রেনের বাকি অংশটি তৈরি করে।

২০১৯ সালের মে'তে রেল মন্ত্রণালয় তৎকালীন পঞ্চগড় স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশন রাখে। পঞ্চগড় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম রেলমন্ত্রীর ভাই।

একজন ব্যক্তির নামে একটি ট্রেন স্টেশনের নামকরণ বাংলাদেশে খুবই বিরল। পঞ্চগড় ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের নামকরণের আর মাত্র ২টি উদাহরণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে সূত্র। একটি সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন ও অন্যটি জামালপুরের অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান স্টেশন।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৯ সাল থেকে যতগুলো প্রকল্প শুরু করেছে, তার কোনোটাই নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে না বলে প্রকল্প-নথি থেকে জানা গেছে।

রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'পঞ্চগড়কে দেশের রেলের রাজধানী বলে মনে হচ্ছে, কারণ মন্ত্রী এটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন।'

আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'পঞ্চগড় অগ্রাধিকার পাবে এটাই স্বাভাবিক। আপনারা জানেন, এটা রেলমন্ত্রীর নিজের জেলা।'

তবে 'পঞ্চগড়কেন্দ্রিক নীতি' অবলম্বন করার বিষয়টি অস্বীকার করে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, আরও উন্নত সংযোগ স্থাপনের জন্যই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

নিজের শহরের জন্য বাড়তি সংখ্যক নতুন ট্রেন সেবা চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, 'পঞ্চগড় (উত্তরের) দেশের শেষ গন্তব্য, তাই।'

তিনি ঢাকাকে যশোরের সঙ্গে যুক্ত করতে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কথাও উল্লেখ করেন। তবে তিনি রেলমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগেই এ ২টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।

২০ অক্টোবর রেল ভবনে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যখন আপনাদের কাছে সমালোচনা করার মতো কিছু থাকে না, তখন আপনারা এসব লেখেন।'

বড় রূপান্তর

২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও দিনাজপুরের মধ্যে দুটি আন্তনগর ট্রেন— দ্রুতজন ও একতা এক্সপ্রেস চলাচল করত। সে মাসেই কর্তৃপক্ষ পঞ্চগড় পর্যন্ত এ সেবা সম্প্রসারণ করে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ৪ ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করে— আন্তনগর, লোকাল, মেইল ও কমিউটার। ৪টির মধ্যে আন্তনগর ট্রেনগুলো সময়সূচির ব্যবস্থাপনা, বসার ব্যবস্থা ও বগির গুণগত মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো সেবা দেয়।

নুরুল ইসলাম সুজন রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার ৪ মাস পর ২০১৯ সালের মে'তে ঢাকা ও পঞ্চগড়ের মধ্যে নতুন ট্রেন 'পঞ্চগড় এক্সপ্রেস' চালু হয়। ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের এই ৩ ট্রেন (দ্রুতজন, একতা ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস) সপ্তাহে ৭ দিনই চলাচল করে। এ ট্রেনগুলোর কোনো বিরতির প্রয়োজন হয় না। কারণ এদের জন্য ১টি বাড়তি রেক রয়েছে, যা বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা।

অন্য প্রতিটি আন্তনগর ট্রেন সপ্তাহে অন্তত ১ দিন বন্ধ থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'আগের মন্ত্রীদের আমলেও ঢাকার সঙ্গে তাদের নিজ জেলার মধ্যে ট্রেন চলাচল অগ্রাধিকার পেত। কিন্তু অতিরিক্ত রেক সরবরাহর মতো কোনো ঘটনা দেখা যায়নি।'

২০২০ সালের অক্টোবরে রাজশাহী ও পঞ্চগড়ের মধ্যে বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস নামে একটি নতুন আন্তনগর ট্রেন চলাচল শুরু করে।

নতুন এই ট্রেন সেবা চালু করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেসের অপেক্ষাকৃত নতুন রেকটি ফিরিয়ে নেয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-বেনাপোল ট্রেন সেবার উদ্বোধন করেন বলে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।

যখন যশোরের যাত্রীরা জানতে পারেন যে, বেনাপোল এক্সপ্রেসের রেকটি খুলে নিয়ে সে জায়গায় একটি পুরনো রেক দেওয়া হয়েছে, তখন তারা বিক্ষোভ করে প্রতিবাদ জানান।

একজন বিক্ষোভকারীর বরাত দিয়ে স্থানীয় পত্রিকা 'সমাজের কথা' গত ২২ মে জানায়, 'রেলমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার ছিনিয়ে নিয়েছেন।'

চলতি বছরের জুনে বগুড়ার দিনাজপুর ও শান্তাহারের মধ্যে চলাচলকারী অপর একটি আন্তনগর ট্রেন 'দোলনচাপা এক্সপ্রেসকে' পঞ্চগড় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের দিনাজপুর চ্যাপ্টারের আহ্বায়ক এ কে আজাদ বলেন, 'আমি জানি না কেন সব আন্তনগর ট্রেনকে দিনাজপুর থেকে সরিয়ে পঞ্চগড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা দিনাজপুরের জনগণকে বঞ্চিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়।'

তিনি আরও জানান, এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে দিনাজপুর থেকে আসা যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। কারণ তারা এখন অপেক্ষাকৃত কম টিকিট পান।

এদিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট, ঢাকা-চট্টগ্রামে গত ৬ বছরে নতুন কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন পায়নি।

বর্তমানে এই রুটে প্রতিদিন ৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। সর্বশেষ আন্তনগর ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস এই রুটে যুক্ত হয় ২০১৬ সালে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ঈদের আগে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামলাতে ঢাকা-খুলনা রুটে একটি বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করত। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় গত ঈদুল আজহার আগে এই বিশেষ ট্রেন বাতিল করা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম জোনের কর্মকর্তারা ঢাকা-পার্বতীপুর রুটে বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী বলার পর এটি পরবর্তীতে ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে সরিয়ে নেওয়া হয়।

পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে।

গত ১ বছরে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে অর্থায়নের জন্য এই উদ্যোগকে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকসহ অন্তত ৩টি উন্নয়ন অংশীদারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে রেলওয়ে সূ্ত্রে জানা গেছে।

যদি ব্যাংকগুলো তহবিল না দেয়, তবে রেল কর্তৃপক্ষ সরকারি তহবিলের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা বিবেচনা করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

কোনো প্রকল্পই শেষ হয়নি

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের ১টিও শেষ হয়নি।

নুরুল ইসলাম সুজন মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে, যার উদ্দেশ্য ছিল সুনামগঞ্জ জেলা সদরকে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও রেলপথ তৈরির বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন।

৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এই সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষাটি ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এই সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়া হয়।

চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে আখাউড়া-সিলেট রেলপথকে মিটারগেজ থেকে ডুয়ালগেজে রূপান্তর করতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে তার আমলের দ্বিতীয় প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।

এরপর ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের ভৌত কাজ এখনো শুরুই হয়নি। প্রকল্পের ব্যয় সংকোচনের পর চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার কাজ চালিয়ে যেতে অস্বীকার করে। ফলে কর্মকর্তারা এখন এই প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে সন্দিহান। প্রকল্পের বর্তমান সময়সীমা ২০২৫ সালের জুন, যার মধ্যে এর কাজ কোনোভাবেই শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র।

অন্য সব প্রকল্পও প্রায় একই রকম পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভৌত কাজ এখনো শুরু হয়নি এবং অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় সময়সীমা বৃদ্ধি ও ব্যয় সংশোধন করতে চাইছে। এর কারণ জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী করোনাভাইরাস, প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন ও বিভিন্ন বাস্তব সমস্যাকে দায়ী করেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments