বিশ্লেষণ

ধর্মঘটে জনদুর্ভোগ ছাড়া আর কী অর্জন হলো

সব বাধা উপেক্ষা করেই তারা এসেছেন, এখনো আসছেন। কেউ ট্রলারে, কেউ বাসে, কেউ লঞ্চে, এমনকি সাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বাংলাদেশের প্রচলিত প্রায় সব যানবাহনে চেপেই তারা গন্তব্যে এসেছেন। তাদের সবার গন্তব্য বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যান। আগামীকাল শনিবার সেখানে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ।
বিভাগীয় সম্মেলন সফল করতে বরিশালে বিএনপির মিছিল। ছবি: টিটু দাস/টার

সব বাধা উপেক্ষা করেই তারা এসেছেন, এখনো আসছেন। কেউ ট্রলারে, কেউ বাসে, কেউ লঞ্চে, এমনকি সাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বাংলাদেশের প্রচলিত প্রায় সব যানবাহনে চেপেই তারা গন্তব্যে এসেছেন। তাদের সবার গন্তব্য বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যান। আগামীকাল শনিবার সেখানে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ।

যেহেতু তারা বিএনপির নেতা-কর্মী, সেহেতু সমাবেশে তো তারা আসবেনই। কিন্তু, ২ দিন আগে থেকেই কেন তারা সমাবেশে আসা শুরু করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তারাই। 

সমাবেশের প্রায় ১০ থেকে ১২ দিন আগেই বরিশালে বাস ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, সমাবেশের আগে থেকেই ধারণা ছিল যে তাদের থামিয়ে দেওয়ার যত রকমের চেষ্টা করার, সরকারি দলের পক্ষ থেকে তা করা হবে। চেষ্টাও হয়েছিল সেরকম কিছুর। কিন্তু, তাদের থামানো যায়নি।

পথে নানা বাধা অতিক্রম করে বরিশাল পৌঁছানোর পর বরগুনা জেলা যুবদলের মিছিল। ছবি: টিটু দাস/স্টার

বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধের দাবিতে তারা আগেই ৪ ও ৫ নভেম্বর ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন। 

তাদের দাবি, মানুষ বিষয়টি আগে থেকেই জানত।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, 'আমরা আগে থাকতেই ৪ ও ৫ তারিখ ধর্মঘটের বিষয়ে জানিয়েছি। এই মুহূর্তে ধর্মঘটের সময়সীমা বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই।' 

এই যে সমাবেশের অনেক আগে থেকেই বাস ধর্মঘট ডাকতে দেখা গেল, অন্য সময় হলে সরকার-প্রশাসন তা নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু, এবার সেরকম দেখা গেল না। এবার কি তাহলে ধর্মঘটের ফলে জনদুর্ভোগ হবে না?

শুধু বাস নয়, থ্রি হুইলার ধর্মঘটও শুরু হয়েছে তাদের 'কথিত' ৫ দফা দাবিতে। আজ শুক্রবার সকাল থেকে খেয়া চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলাম। তাহলে এ ধর্মঘট কার জন্য?

বাস-লঞ্চ বন্ধ থাকায় ট্রলার ভাড়া করে অন্যান্য জেলা-উপজেলা থেকে বরিশালে সমাবেশস্থলে যাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ছবি: টিটু দাস/স্টার

জনগণকে বিচ্ছিন্ন করার যে উদ্যোগ, সেই উদ্যোগকে সরকার সমর্থন দিয়ে গেল? প্রশাসন ধর্মঘট প্রত্যাহারের চেষ্টাটুকুও করল না?

ধর্মঘটের বিষয়ে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, 'বাস মালিকরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট ডেকেছেন। এখানে আমরা কাউকে বাধাগ্রস্ত করিনি। আমরা যুবলীগের সাফল্য জানিয়ে মিছিল করেছি। বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।'

বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবেই এর পেছনে রাজনৈতিক মদদের কথা বলা হয়েছিল। তারা সংবাদ সম্মেলন করে এ ধর্মঘটের পেছনে সরকারি দলের জোর-জবরদস্তির কথা উল্লেখ করেছে। এমনকি তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের আবেদনও জানিয়েছিল। কিন্তু, তাদের আবেদন-নিবেদন, সবই যে অরণ্য রোদনে পর্যবসিত হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন হলো, এ অবরোধ-ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীদের নিবৃত্ত করতে পারল না কেন? 

বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যান। ছবি: টিটু দাস/স্টার

এই প্রশ্নে বিএনপির শ্রম বিষয়ক সহকারী সম্পাদক মো. ফিরোজ–উজ-জামান মামুন মোল্লা বঙ্গবন্ধু উদ্যান থেকে বলেন, 'যখন কোনো বাধা দেওয়া হবে, তখন কিন্তু ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হবে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে যে চিত্র দেখা গেছে, সত্যিই সেটা এরকমই। মাঠে চাল-ডাল নিয়ে এসেছেন নেতা-কর্মীরা। তারা নিজেরাই চাঁদা তুলে এসব ব্যবস্থা করেছেন। এটাই তৃণমূল স্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এর ফলে কে কীভাবে আসবে, এ নিয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ বা কেন্দ্রের খরচের কোনো বিষয় ছিল না।'

'বঙ্গবন্ধু উদ্যানে এ মুহূর্তে যে কেউ গিয়ে দেখতে পাবেন যে, মাঠেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। তারা কেউ মিছিল করছেন, কেউ মাঠে বসে গল্প করছেন। কেউ রান্না করছেন। চারিদিকে উৎসবমুখর মেলার পরিবেশ। এই পরিবেশ যে "টাকা দিয়ে মানুষ আনার" রাজনীতি থেকে ভিন্ন, তাতে সন্দেহ নেই। তা না হলে সুদূর পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন থেকে ৩ দিন আগে মানুষ আসে কেন? কিসের এত তাগিদ তাদের', যোগ করেন তিনি।

যারা ইতোমধ্যে এসেছেন, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, তারা নানারকম হয়রানির আশঙ্কা থেকে আগেই এসেছেন। কেউ কেউ পথে নিগ্রহ, হয়রানি হুমকি-ধামকি, এমনকি মারধরেরও শিকার হয়েছেন। কিন্তু, এসব কিছু তৃণমূলের এই রাজনৈতিক কর্মীদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

দাবিয়ে রাখার কথা বলছি এই জন্য যে, মানুষের চলাচলের, কথা বলার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু, বরিশালে এই লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রায় কেউই কোনো উচ্চবাচ্য করল না। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় থাকাকালীন জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে মাথা ঘামান খুব কম। অনেক খবর তারা জানতেও পারেন না। ফলে তাদের ও জনগণের মধ্যে এক সময়ে এসে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। সেই কারণে তারা সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সহজ-সাবলীল কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। কিন্তু, এতে যে হিতে বিপরীত হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

Comments