ধর্মীয় অনুভূতির আড়ালে কী?

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মন্দিরে আগুন লাগানোর সঙ্গে নিহত দুই ভাইয়ের যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ শতাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন হলো, ওই মন্দিরে কে বা কারা আগুন দিলো এবং কেনই বা দুই সহোদরকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো? কারা মন্দিরে আগুন দেওয়ার খবর ছড়িয়ে স্থানীয়দের খেপিয়ে তুললো? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে যে নিরীহ দুজন মানুষকে মেরে ফেলা হলো, তার দায় কে নেবে?

প্রসঙ্গত, গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ডুমাইন ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত পঞ্চপল্লী গ্রামের একটি কালী মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত নির্মাণশ্রমিকদের ওপর হামলা হয়। তখন স্কুলের টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছিল। পিটুনিতে দুই শ্রমিকের প্রাণ যায়। তারা হলেন, উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ঘোপেরঘাট গ্রামের ২১ বছর বয়সী আশরাফুল এবং তার ভাই ১৫ বছর বয়সী আশাদুল। এ ঘটনায় আহত হন আরও পাঁচ শ্রমিক।

শুরু থেকেই মধুখালীর এই ঘটনাটি স্থানীয় প্রশাসন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে। কেননা মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা এবং আরও কয়েকজনকে আহত করার খবর দ্রুত আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই জাতীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হতে পারতো। ওই গ্রামের হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারতো।

রামু ও নাসিরনগরের ঘটনা দেশবাসীর স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। এরকম ঘটনায় তৃতীয় কোনো পক্ষ সুযোগ নেয় এবং মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। অতএব ফরিদপুরের স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এরকম একটি পরিস্থিতি এড়াতে যে ভূমিকা রেখেছেন, যেভাবে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, সেটি প্রশংসার দাবি রাখে।

এই ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও অভিযোগের তীর মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মো. আসাদুজ্জামান তপন এবং সদস্য অজিত বিশ্বাসের দিকে। তাদেরকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কারের ঘোষণাও দিয়েছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসন।

মধুখালীর ঘটনায় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, এখানে সত্যিই ধর্মীয় অনুভূতিই মূল ভূমিকা পালনে করেছে, নাকি এর আড়ালে অন্য কিছু আছে?

ফরিদপুরের এই ঘটনার নয় দিনের মাথায় পাশের জেলা শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় রক্ষিতকে (৪০) আটক করে পুলিশ। অভিযোগ, ফেসবুকে লালন সাঁইয়ের 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে' গানের দুটি লাইনের আদলে 'সুন্নতে খাতনা দিলে যদি হয় মুসলমান/তাহলে নারী জাতির কি হয় বিধান' লিখে তিনি পোস্ট করেছিলেন। এতে তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ উঠলে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয় এবং পরে পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যায়। যদিও পরে তিনি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

একই প্রশ্ন ভেদরগঞ্জের ঘটনায়ও। এখানেও কি ধর্মীয় অনুভূতি উসিলামাত্র? কেননা, এর আগেও ফেসবুকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে পোস্ট দেওয়ার ঘটনায় এমন অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং পুলিশ এমনও অনেককে এমন সব স্ট্যাটাস বা মন্তব্যের কারণে গ্রেপ্তার করেছে, যার চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস পোস্ট ও কমেন্ট করার পরেও অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি বা তারা গ্রেপ্তার হননি।

এখনো প্রতিনিয়ত অনেকেই ফেসবুকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নানা বিষয়ে তাদের মতামত দেন। অনেকে উসকানিমূলক বা অন্য ধর্মের মানুষকে হেয় করেও প্রচুর পোস্ট ও কমেন্ট শেয়ার করেন। কিন্তু তাদের সবার বিরুদ্ধে কি মামলা হয় বা তাদের সবাইকে কি পুলিশ গ্রেপ্তার করে?

প্রশ্ন হলো, পুলিশ কাদেরকে ধরে বা কাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় কিংবা মানুষ কাদের বিরুদ্ধে জড়ো হয়? জড়ো হয় নাকি জড়ো করা হয়—প্রশ্নটা সেখানেই। অর্থাৎ ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ঈর্ষা থেকে অনেক সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটে।

ভেদরগঞ্জের ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে হয়তো এমনই কারো ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক বিরোধ রয়েছে। যার ফলে তিনি একটি পোস্ট দিলেন বলে সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে ধর্মীয় রঙ চড়িয়ে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ তুলে তার প্রতিপক্ষ হয়তো আরও অনেককে খেপিয়ে তুলেছেন। আর এটা ঠিক যে মানুষকে ধর্মীয় ইস্যুতে সবচেয়ে দ্রুত খেপিয়ে তোলা যায়।

স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৯ সালে বরিশালের কবি হেনরি স্বপনকেও এমন একটি ফেসবুক পোস্টের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং মামলাটি এখনো চলমান। যদিও তারচেয়ে অনেক সিরিয়াস ও আক্রমণাত্মক পোস্ট প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। অথচ হেনরি স্বপনের বিরুদ্ধে মামলা হলো। পুলিশ দ্রুততম সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করলো। তিনি বেশ কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন।

পরে জানা গেলো, বরিশাল শহরে তার ধর্মের কিছু লোকের সঙ্গেই তার পেশাগত কারণে বিরোধ ছিল, যারা তার ওই ফেসবুক পোস্টকে উসিলা বানিয়ে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের লোকজন অপেক্ষায় থাকে যে কখন কাকে ধরা যায়। আর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পোস্ট বা কমেন্ট দিয়ে যত দ্রুত কাউকে ঘায়েল করা যায় বা যত দ্রুত কাউকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা যায়, অন্য কোনো ইস্যুতে সেটি সম্ভব হয় না।

ঝালকাঠির সাংবাদিক আককাস সিকদারের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল শুধুমাত্র রাস্তায় পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে একজনের পোস্টের নিচে তিনি একটি মন্তব্য লিখেছিলেন বলে। যেরকম মন্তব্য প্রতিনিয়তই ফেসবুকে অহরহ চোখে পড়ে। অথচ আককাস সিকদারের বিরুদ্ধে মামলা হলো। পরে জানা গেলো, এই মামলার পেছনে তার পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের একটি অংশই ভূমিকা রেখেছেন।

এভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইস্যুতে দেওয়া পোস্ট ও কমেন্টের বিরুদ্ধে এ যাবৎ যতগুলো মামলা হয়েছে, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তার বিরাট অংশের পেছনেই রয়েছে অভিযুক্তের সঙ্গে কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা তাদের প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত শত্রুতা। ধর্মীয় অনুভূতি এখানে কেবল একটি অনুঘটকের কাজ করে। কেননা ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে দ্রুতই মানুষকে উত্তেজিত করা সম্ভব।

ধর্মের সঙ্গে অনুভূতির সম্পর্ক নিবিড়। কেন না সেই অনুভূতির ভেতরে আছে বিশ্বাস। মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে বিষয়ে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সে প্রস্তুত নয়। তার কাছে যুক্তিও মুখ্য নয়। কারণ, তার বিশ্বাসের ভিত বেশ জোরালো। আর মানুষের মনে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত যত জোরালো হয়, সে তত বেশি ভীত হয়। এই ভীতি পরকালীন শাস্তির।

অতএব, সে যখনই তার সেই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ হতে দেখে কিংবা তার ধর্ম অথবা ধর্মের অবতারের সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য দেখে, সে ক্ষুব্ধ হয়। কারণ তার অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বলে সে মনে করে এবং তখন এই আঘাতের জবাব দিতে চায়।

প্রশ্ন হলো, কার অনুভূতিতে কে আঘাত করে এবং ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তার ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হয়? রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন কী বলছে এবং ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাখ্যাই বা কী?

তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, কে, কখন, কাকে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন উদ্দেশ্যে কাউকে উত্তেজিত করে এবং উত্তেজিত হয়ে কারা অন্যের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা চালায়?

ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ যদি সঠিক হয় এবং প্রচলিত আইনে যদি এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সম্প্রদায়ের ওপরে সংগঠিত আক্রমণের হেতু কী এবং কারা এর পেছনে ইন্ধন যোগায়?

অস্বীকার করার উপায় নেই, যেকোনো আক্রমণ ও হামলা-মামলার পেছনে সব আমলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো না কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যোগসাজশ থাকে। অনেক সময় তারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্মতি আদায়ের জন্যও এসব ঘটনায় নিজেদের যুক্ত করেন—যার পেছনে প্রধানত কাজ করে দখল, লুটপাট এবং ভোটের রাজনীতি। ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতি সেখানে উসিলামাত্র।

অন্যদিকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অনেকের খোঁচানোর স্বভাবও আছে। অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে, নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা বা অগ্রসর প্রমাণ করতে গিয়ে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এমন সব মন্তব্য করেন বা লেখেন, যা অনেক সময় মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কী ধরনের আলোচনার জন্য আমাদের সমাজ প্রস্তুত বা কতটুকু সমালোচনা সহ্য করতে পারে, সেই বাস্তবতাটি মাথায় রাখা দরকার।

কিন্তু যে প্রশ্নটি বারবার সামনে আসে তা হলো, ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী বা এর মানদণ্ড কী? দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উপাসনালয় ভাঙচুরের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও কী কী কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে তা বলা নেই।

ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতির কোনো সংজ্ঞা এখনো দেশের প্রচলিত আইনে অস্পষ্ট। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাম্প্রতিক সাইবার নিরাপত্তা আইনেও বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

অতএব শরীয়তপুরে লালনের গান ফেসবুকে শেয়ার করার কারণে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো এবং ফরিদপুরের মধুখালীতে ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে যে দুজন মানুষকে মেরে ফেলা হলো, আসলেই এর পেছনে অন্য কিছু আছে কি না—সেটি খুঁজে বের করা জরুরি।

এ জাতীয় ঘটনার বিচার যেমন জরুরি, তেমনি এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেই চেষ্টাটা আরও জরুরি। কেননা ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে অনেক সময় মূল ঘটনা আড়াল করা হয়। ব্যক্তিগত শত্রুতাকেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক রঙ দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে দেওয়া হয়।

এর সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিকটি হলো, ধর্মীয় অনুভূতির নামে এসব ঘটনার কারণে ধর্মের প্রতি মানুষের বিরক্তি তৈরি হয় এবং যারা সব সময়ই সমাজে ও রাষ্ট্রে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ের রাখতে চায়, তারা এ জাতীয় ঘটনায় উসকানি দিয়ে বড় ধরনের দাঙ্গা লাগানোর ধান্দায় থাকে। ফলে যখনই ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সামনে আসে, তখন এসব লোককে চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে যায়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

12h ago