যে পথ ধরে হাঁটলেই ভেসে আসে বইয়ের ঘ্রাণ

বাংলাবাজার
ছবি: স্টার

পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বাংলাবাজার। শত শত বইয়ের দোকানের জন্য বিখ্যাত এই জায়গা। এখানকার যেকোনো পথ ধরে হাঁটলেই নাকে ভেসে আসে বইয়ের ঘ্রাণ। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে হাজারো বইয়ের এই বাজারই হলো বাংলাবাজার।

ছবি: স্টার

যেভাবে শুরু

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে বাংলাবাজারে শুরু হয় বইয়ের ব্যবসা। তবে, ওই সময়ে সৃজনশীল নয়, পাঠ্য বইয়ের চাহিদা ছিল বেশি। যদিও, দেশভাগের আগে কলকাতায় প্রকাশনা ব্যবসা ছিল জমজমাট। তখন পুরান ঢাকার অল্প কজন প্রকাশক বাংলাবাজারে সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা করতেন, তা-ও আবার কলকাতা থেকে। তখন এই ব্যবসা অনেকটাই কলকাতার সাহিত্য-নির্ভর ছিল। মল্লিক ব্রাদার্স কলকাতা থেকে এসে বাংলাবাজারে সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন সেই সময়ে।

শুরুর গল্প

বর্তমানে বাংলাবাজারে সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা প্রসার লাভ করলেও শুরুতে ভিন্ন চিত্র ছিল। পঞ্চাশের দশকে অল্প কয়েকজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যাদের হাত ধরে এদেশে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট লাইব্রেরি, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরি, আল হামারা কিতাব মহল, মালিক লাইব্রেরি, খোশরোজ কিতাব মহল, হার্ডসন অ্যান্ড কোম্পানি, পুঁথিপত্র...ইত্যাদি। মূলত দেশভাগের পর এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা শুরু করে। সেই সময়ে কিছু কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশকরাও লেখক ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম একজন হলেন শিশু সাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী। তিনি ছিলেন নওরোজ কিতাবিস্তানের কর্ণধার।

ছবি: স্টার

টিনের ঘর থেকে বহুতল ভবন

বাংলাবাজারের প্রকাশকরা জানান, ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাবাজারের বেশিরভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল টিনের ঘরের। ধীরে ধীরে এই অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটে। একে তো টিনের ঘর, তার ওপর বাংলাবাজারের ঘরগুলো ছিল একতলা। কিন্তু এখন বাংলাবাজারের ঢুকলেই অন্য চেহারা দেখা যায়। অসংখ্য ভবন হয়েছে এখানে। মান্নান মার্কেট সবার কাছে খুব পরিচিত। এই মার্কেটের নিচতলা থেকে থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বইয়ের দোকান।

আশির দশকে বদলাতে শুরু করে বাংলাবাজার

দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলই কেবল নয়, বাংলাবাজার থেকে বই এখন বিশ্বের বহু দেশেই যাচ্ছে। আশির দশক থেকে বাংলাবাজারের চিত্র বদলাতে শুরু করে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাড়তে শুরু করে। বাড়তে থাকে লেখকের সংখ্যাও। সেজন্য আশির দশককে বলা হয় বাংলাবাজারের প্রকাশকদের সুন্দর সময়। কেননা, এই সময়ে—আগামী, সময় প্রকাশন, অনন্যা, বিদ্যা প্রকাশ, আফসার্স ব্রাদার্স, অনুপমসহ অনেকগুলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা শুরু করে।

ছবি: স্টার

বাংলাবাজারের বইয়ের যত মার্কেট

বাংলাবাজারে কয়েক দশকের পথচলায় অনেকগুলো মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেই পুরোনো টিনের ঘর এখন নেই। তিনতলা, চারতলা মার্কেট যেমন রয়েছে, আছে বহুতল ভবনও। মান্নান মার্কেট বেশ পরিচিত। এখানে অনেকগুলো দোকান রয়েছে সৃজনশীল প্রকাশকদের। ইসলামি টাওয়ার নামে একটি মার্কেট গড়ে উঠেছে। ৩৮ নম্বর মার্কেট নামে একটি বইয়ের মার্কেট আছে। আরও আছে গিয়াস গার্ডেন মার্কেট, বিশাল বুকস মার্কেট, কম্পিউটার কমপ্লেক্স, রোমি মার্কেট, কাওমি মার্কেট, বই বিচিত্রা মার্কেট ইত্যাদি।

একসময় নথব্রুক হল রোডকে ঘিরেই বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলো ছিল। সেই দিন আর নেই। আশপাশে অনেক জায়গাজুড়েই এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে। নর্থব্রুক হল রোড, প্যারিদাস রোড ও হেমেন্দ্র চন্দ্র দাশ রোড পর্যন্ত বইয়ের বাজার।

বাংলাবাজার নামটি যেভাবে এলো

সেই সময়ে কোনো কোনো পর্যটক বাঙলা নগর বলতেন বাংলাবাজারকে। তবে, মোগল আমলের আগেই ঢাকা শহরের পুরোনো জায়গা হিসেবে বাংলাবাজার নামটি এসেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সেই সময়ে এই এলাকাটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও পরিচিত ছিল। ধীরে ধীরে এখান থেকে ব্যবসা আরও দূরে বিস্তৃতি লাভ করে। একসময় চকবাজার পর্যন্ত চলে যায় ব্যবসা। কিন্তু বাংলাবাজার নামটি রয়ে যায়। আর এখানেই গড়ে ওঠে বইয়ের ব্যবসা। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাবাজার এলাকায় বাঙালিরা বসবাস করতেন একটা সময়ে। সেসব বাঙালিরা একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম হয়ে যায় বাংলাবাজার।

ছবি: স্টার

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বইয়ের দোকান

বাংলাবাজারে এখন শত শত সৃজনশীল বইয়ের দোকান। একজন প্রকাশক বলেন, কম করে হলেও দুই হাজারের ওপরে বইয়ের দোকান রয়েছে বাংলাবাজারে। তা ছাড়া, সৃজনশীল প্রকাশ রয়েছেন চার শতাধিক। প্রতিটি বইয়ের দোকানে তিন থেকে চারজন কর্মচারী কাজ করেন দোকানগুলোতে। অন্যদিকে, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলাবাজার ও আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেকগুলো ছাপাখানা ও বাঁধাইখানা।

বাংলাবাজারে আড্ডা

বাংলাবাজার সংলগ্ন বিউটি বোর্ডিং। একটা সময়ে এই বিউটি বোর্ডিংয়ে বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি ও লেখকরা আড্ডা দিতেন। এই আড্ডা বছরের পর বছর ধরে চলেছে। বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই আড্ডা এখন আর নেই। তবে, বাংলাবাজারে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আড্ডা বসে। ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে কবি ও লেখকরা বাংলাবাজারে আসেন নতুন বই প্রকাশনার জন্য। এখনো অনন্যাসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনই আড্ডা বসে।

Comments

The Daily Star  | English

Trump, Putin in Alaska to end Ukraine war

Donald Trump and Vladimir Putin flew to Alaska yesterday for a high-risk summit that promises a stern test of the US president’s promise to end the bloody war in Ukraine.

5h ago