বিএনপির সমাবেশ: সরকার ও সরকারি দলের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত

দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধীদল বিএনপির খুলনা ও ময়মনসিংহের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার যা করেছে তাতে সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটুকু লাভবান হয়েছে? খুলনার সমাবেশের আগের দিন সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে সরকার তারই সৃষ্ট এবং তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত পরিবহন মালিক সমিতি নামীয় দানব বাহিনীর নামে ধর্মঘট ডাকিয়ে দিয়েছে। 

ধর্মঘট ডাকতে গরিবের বাহন বেচারা 'নসিমন-করিমনকে' ব্যবহার করা হয়েছে। যেন সড়কে প্রতিদিন যে দানব-চক্রযানের চাকায় শত শত মানুষ পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে, তার জন্য এই নসিমন-করিমনই দায়ী।  

যখন দেখল স্থলপথ ছাড়া জলপথেও মানুষ আসতে পারে, তখন সেখানেও তারা ধর্মঘট ডাকিয়ে দিলো। এবারের অজুহাত হলো মজুরি বৃদ্ধি। এমনকি সাধারণ ঘাটের খেয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হলো। 

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আকাশপথে গণমানুষের চলাচলের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আকাশপথেও কিছু একটা অজুহাতে ধর্মঘট ডাকিয়ে দেওয়া হতো। হয়ত বলা হতো, পাখিদের কারণে যান চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। তাই আকাশে পাখি চলাচলের প্রতিবাদে এই ধর্মঘট।  

খুলনার আগে ময়মনসিংহ সমাবেশের সময়ও এমন হয়েছিল। তবে, যেহেতু ময়মনসিংহ বিভাগে জলপথের তেমন ভূমিকা ছিল না, তাই সেখানে জলপথে ধর্মঘটের প্রয়োজন পড়েনি। 

সমাবেশের আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলা থেকে ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহগামী বাস, ট্রাকসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেন মানুষ ময়মনসিংহ না যেতে পারে। তারপরও মানুষ গিয়েছে, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নদীপথে,  কেউবা সাধারণ রিকশা-ভ্যানে। 

খুলনাতেও তাই ঘটেছে। সব কিছু বন্ধ করেও যখন মানুষকে ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন হেঁটে আসা মানুষের ওপর সরকারি বাহিনী চড়াও হয়েছে।  

প্রশ্ন হলো, সরকার বা সরকারি দল এমন করে কেন? এর ফলে যে জনভোগান্তির সৃষ্টি হয়, তা কি তারা বুঝতে পারে না?

খবরে দেখলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ আসতে গিয়েও অনেকে আসতে পারেননি। আরও দেখলাম, গফরগাঁওয়ের এক শ্রমিককে বিএনপির কর্মী ভেবে সরকারি দলের লোকেরা মারধর করে হাত কেটে দিয়েছে। একই দৃশ্য খুলনাতেও। অনেকেই চাকরির পরীক্ষা দিতে পর্যন্ত যেতে পারেনি।  

এসব করে সরকারের ইমেজ কি ভালো হচ্ছে? নাকি আরও খারাপ হচ্ছে? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কি এসব বোঝেন না? আমি মনে করি, নিশ্চয়ই বোঝেন। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি বুঝেই থাকেন তাহলে তারা এমন করেন কেন? এত অজুহাতের আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিলেই তো হয়? 

না, তাহলে একটু মুশকিল আছে। বিরোধীদলের সভা-সমাবেশের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে আন্তর্জাতিক প্রভু, প্রভুর প্রভু, মহাপ্রভুরা সরকারের ওপরই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসতে পারে। সে কারণেই এতসব ছলনার আশ্রয়।

তবে, বিষয়টি শুধু বিএনপির ক্ষেত্রেই নয়, সব বিরোধীদলের ক্ষেত্রেই একই খেলা। বিএনপি বড় দল বলেই এটি একটু বেশি চোখে পড়ে। আসলে সব বিরোধীদলের সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রেই এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে সরকার। 

সমাবেশ করতে গেলে প্রশাসনের অনুমতি লাগবে। আর এ ক্ষেত্রে প্রশাসন মানেই পুলিশ। ডিসি বা ইউএনওরা তাদের স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রধান হলেও, পুলিশের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া সভা-সমাবেশের অনুমতি দিতে পারেন না। 

আর, পুলিশের কাছে গেলে তো হাজারো শর্ত! যদি অনুমতি মিলে, তাতেও বলে দেওয়া হয় বক্তৃতায় কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না! 

বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি  দল। সিপিবির মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দলটিকে পর্যন্ত সরকার সভা-সমাবেশ করতে দিতে চায় না। এই তো মাসখানেক আগেই নেত্রকোণার কলমাকান্দায় দলটিকে সভা করতে দেয়নি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। 

বর্তমানে এই অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে বিরোধীদলের সভা-সমাবেশের ওপর পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার খড়গ আরও বাড়বে। কিন্তু কেন?

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। এই দীর্ঘ সময়ে সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে বিরাট উল্লম্ফন ঘটিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, প্রমত্তা পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ করেছে, অগুনতি ফ্লাইওভারে ঢেকে দিয়েছে ঢাকার আকাশ, আরও কত কী! 

কিন্তু তারপরও সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলীয়করণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানকে একে একে ধ্বংস করে চলেছে। এর ফলে আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান নিয়ামক সুশাসনের বিষয়টি রাষ্ট্র থেকে ক্রমেই 'উধাও' হওয়ার পথে। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়াসহ বিরোধী মত ও দল দমনে এমন কোনো কাজ নেই যা সরকার করছে না।

অন্যদিকে মেগা প্রকল্পের নামে চলছে দুর্নীতির 'মেগা' উৎসব। বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। ফলশ্রুতিতে মুষ্টিমেয় কিছু লোক যেমন আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। 

অন্যদিকে দলের ভেতরে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে আদর্শবাদী নেতাকর্মীরা হয়ে পড়ছে কোণঠাসা। নেতারা জনগণের চেয়ে বেশি আস্থা রাখছে আমলাতন্ত্রের ওপর। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সরকারি দলের রাজনীতি এখন আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। 

আগে রাজনীতিবিদরা দূরে কোথাও গেলে কর্মীদের বাড়িতে উঠতেন, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করতেন। এখন আর সে রেওয়াজ নেই। এখন সরকারদলীয় নেতারা ডিসি-এসপির প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করেন। কারণ তারা জানেন প্রশাসনের লোক সঙ্গে না থাকলে মানুষ তাদের পেছনে হাঁটবে না।

এসব কারণেই জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের থেকে। সরকার এ কথাটা ভালোই জানে। আর জানে বলেই বছরখানেক পরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো ধরনের ঝুঁকি  নিতে চায় না। 

সরকার এটাও জানে যে ব্যক্তি যখন সংঘবদ্ধ হয়, তার মাঝে এক অমিত শক্তি জেগে ওঠে, যার সামনে কোনো অশুভ শক্তিই টিকতে পারে না। যেমন টিকতে পারেনি এরশাদ,  কিংবা তারও আগে আইয়ুব খান।

এরশাদও দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক কাজ করেছিল, আইয়ুবও করেছিল। আইয়ুবের আমলেই এ দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। আজকের সংসদ ভবন কিংবা  কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন আইয়ুবের আমলেরই কাজ। এসবের পরও তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল জনরোষের চাপে। 

আইয়ুব কিংবা এরশাদ উন্নয়নের প্রলেপ দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষাকে চাপা দিতে চেয়েছিল, পারেনি। কারণ জনগণের নাড়ি তারা বুঝতে পারেনি। আর, জনগণের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার কাজটা করতে পারে শুধু রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দল, যেমনটি পাকিস্তান আমলে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ।

এ সব ইতিহাস সরকারের জানা। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিতে চায় না তারা। না হলে ময়মনসিংহ কিংবা খুলনার মতো জনদুর্ভোগ পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করত না। 

এই যে খুলনা কিংবা ময়মনসিংহে যা ঘটানো হলো তাতে কার লাভ হয়েছে? কোনভাবেই বলা যাবে না সরকার বা সরকারি দল লাভবান হয়েছে। বরং সরকারের এমন কার্যকলাপ বিএনপির সমাবেশে আরও বেশি মানুষ টেনেছে। 

অন্যদিকে ভোগান্তিতে পড়া সাধারণ মানুষের আওয়ামী লীগের প্রতি যে সাধারণ সমর্থন ছিল, ভবিষ্যতে তা না থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যে ছেলেটি বা মেয়েটি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিংবা যে মানুষটি তার কোনো আপনজনকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ বা খুলনা যেতে চেয়েছিলেন এবং যখন তিনি তা পারলেন না, তিনি কি আর কখনো  মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দলটিকে পছন্দ করবে?

একইভাবে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ যে ভাসমান ভোটার আছে তারা কি ভবিষ্যতে ভোট দেওয়ার সময় আজকের দুর্ভোগকে ভুলে যাবে? 

সর্বোপরি, সমাবেশে বাধা-নিষেধের কারণে বিএনপি যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছে বা পাচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থায় তারা কি তা পেত? তাহলে সরকারের এই কার্যক্রম পরোক্ষভাবে কি বিএনপিকেই সাহায্য করছে না? এই প্রশ্নগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত।

বর্তমানে দেশে এবং সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সব দল মিলেমিশে কাজ করা আজ সময়ের দাবি। তা না করে 'একে ঠেকাও, ওকে ঠেকাও'  এমন রাজনীতি যদি চলতে থাকে, তাহলে দেশে গণতন্ত্রের যে নিভুনিভু শিখাটি এখনো জ্বলছে, তা একেবারেই নিভে যাবে। তখন তা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। আর, তা হবে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ। 

তাই দেশের মুমূর্ষু গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকার এবং সরকারি দলকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে জনতার স্রোতকে আটকানো যায় না। যে কোনো সমাজের বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে উৎসারিত এবং অন্তর থেকে জেগে ওঠা অমিত শক্তিই মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাই সত্য৷ এটাই ইতিহাস।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago