সবাই কেন এমপি হতে চায়

যারা এমপি হতে চান, তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। কেবল এটুকু বলা যে, রাজনীতিবিদরা, ব্যতিক্রমী উদাহরণ বাদে, যেকোনো পেশাজীবীর চেয়ে জনগণকে ভালো বোঝেন, জনগণের চাওয়া-পাওয়াটা আমলে নেন। এ কারণে রাজনীতিটা তাদেরকেই মানায়। আপনাদেরকে যেমন মানায় অন্যক্ষেত্রে।

দেশে রাজনীতি কি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা? রাজনীতি যেভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার রাজনীতি যে উপায়ে সবক্ষেত্রে কামিয়াব হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে, তাতে যেকারও মনে হতে পারে, রাজনীতির উপরে আর কিছু নেই।

সেই কারণে এ মুহূর্তে দেশের একটা বর্গের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো—রাজনীতির খাতায় নাম লেখানো। তারা শুধু নাম লিখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, এমপি হওয়ার দৌড়েও শামিল হচ্ছেন। রীতিমতো ভিমরি খেয়েও পড়ছেন। প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত যে, সবাই কেন এমপি হতে চায়? নিশ্চয় এর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কারণ আছে। এ লেখা সেই কারণ তালাশের নিমিত্তে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৭ জানুয়ারি। সেই মোতাবেক বিস্তারিত জানিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের তরফে। নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে যে ধরনের সাজ সাজ রব দেখা দেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান নয়।

ভোট নিয়ে ভোটাররা দুইভাগে বিভক্ত। একভাগ মনে করছেন, আরও একটি একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নিচ্ছে সরকার। যে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও উৎসবমুখর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যপক্ষের দাবি হলো, তারা যা কিছু সংবিধানসম্মতভাবেই করেছেন। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের কাছে নেই। নির্বাচনী ট্রেন এসে গেছে এবং সময়ের হাত ধরে চলেও যাবে। এই ট্রেনে কে উঠল আর কে উঠল না, তা দলগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই।

দুই পক্ষই যখন তাদের তর্ক ও যুক্তিতে অনঢ়, অটল ও অবিচল, তখন বুঝি জাতির ভাগ্যে আরও একটি একতরফা নির্বাচন দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। জাতিকে অবশ্য আরও একটা জিনিস দেখতে হচ্ছে। সেটা হলো—সবার এমপি (সংসদ সদস্য) হওয়ার দৌড়। যে লক্ষ্যে মনোনয়ন ফরম কেনার হুড়োহুড়ি লেগেছে। ব্যাপারটাকে 'হুড়োহুড়ি' বলতেই হচ্ছে। মনোনয়ন কেবল যদি রাজনীতিবিদরা কিনতেন, তা হলে সেটাকে 'উৎসব' বা 'ধুম' বলে শনাক্ত করা যেত। তবে বাস্তবতা সেটা বলছে না। এখানে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকা, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, সাবেক সামরিক ও বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা। এই লক্ষণ ও প্রবণতা ভালো কিছু নয়।

দুয়েকটা ব্যতিক্রম হলে শঙ্কিত হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু সেটা যদি মূল প্রবণতার শক্তিশালী অংশভাগ হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সেটা উদ্বেগের। যা ত্যাগী ও প্রকৃত রাজনীতিবিদদের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে পারে। কালো টাকা যেমন সাদা টাকাকে সরিয়ে দেয়, এভাবে যদি অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষেরা এসে এমপি হয়, তাহলে যারা ফুল টাইম রাজনীতি করেন, তাদের কী হবে? তারা কেন সবকিছু ছেড়ে রাজনীতিকেই ধ্যান-জ্ঞান করবেন? এক জীবন রাজনীতির জন্য উৎসর্গ করবেন? এই সব প্রশ্নের উত্তরের ভেতরেই রয়েছে সবার এমপি হওয়ার বাসনার ক্ষতিকর ও অমঙ্গল দিকগুলো। কয়েকটি প্রশ্নের আলোকে এসবের আরও একটু খোলতাই করলে যেসব বিষয় আমাদের সামনে হাজির হয়, সেগুলো হলো—

এক. যার যা করার, কিংবা যার যে যোগ্যতা আছে, তার সেটা করাই ভালো। বিষয়টাকে সাধারণ অর্থে বলে, যার যেদিকে ঝোঁক বা প্রবণতা রয়েছে, তার সেটাই করা উচিত, যৌক্তিক। বিদ্যায়তনিক জায়গায় বলে বিশেষজ্ঞ বা এক্সপার্ট। অর্থাৎ যে যে বিষয়ে স্পেশালিটি বা বিশেষত্ব অর্জন করেছেন, তার সেটা করাই শোভন ও কল্যাণকর। রাজনীতিবিদরা তো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই পর্যায়ে এসেছেন। অন্যদের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

দুই. অন্য শ্রেণি-পেশাজীবীরা জীবনের মধ্যাহ্ন পেরিয়ে কিংবা পড়ন্ত বেলায় এসে এখন কেন রাজনীতিবিদ হতে চাইছেন? চাওয়া অন্যায় বা অপরাধ নয়। প্রশ্ন হলো, যুক্তিটা কী? রাজনীতিতে তারা আসলে কী লক্ষ্য বা প্রত্যয় জারি রাখতে চান? তারা কি মনে করছেন সেই লক্ষ্য বা প্রত্যয় পূরণে রাজনীতিবিদরা অপারগ বা আগ্রহী নন?

তিন. যেসব তারকারা এমপি হতে চাইছেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন—আপনাদের জীবনের লক্ষ্য কি ছিল এমপি হওয়ার, রাজনীতি করার? নাকি তারকার ইমেজ বা ভাবমূর্তি গড়ে উপলক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হলেন। মওকা বুঝে যদি কিছু হাসিল করতে চান, তাহলে বুঝতে হবে আপনার বা আপনারা আসলে ওইক্ষেত্রের তারকাও হতে চাননি। বাই চান্স হয়ে গেছেন। নিজ নিজ জায়গাতেই যতি আমরা নিজেদের সর্বোচ্চটা না দিই, তাহলে এমপি হলেও কি সেটাই হবে না?

চার. বলা হয় এবং ইদানীং আরও বেশি করে বলা হচ্ছে যে, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সবাই এমপি হওয়ার দৌড়ে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে কি সেই হতাশার চিত্রই প্রকট হয়ে উঠল? তাহলে সবাই মিলে কি রাজনীতিকে আরও বেশি গৌণ ও সংকীর্ণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হচ্ছে?

পাঁচ. যারা এখন হঠাৎ এমপি হতে চান, যারা মনোনয়ন কিনেছেন—তাদের প্রায় প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সম্মানীয়। দেশ ও জাতি তাদের সর্বোচ্চ মান্যতাও দিয়েছে। এরপরও কেন এমপি হওয়ার বাসনা? ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ীর কথা। যিনি ব্যবসা দিয়ে সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছেন। তিনি আসলে এমপি হয়ে কী করতে চান? জনগণের সেবা? এমপি না হলে কি জনসেবা করার সুযোগ নেই? নাকি আসলে এর পেছনে গূঢ় কোনো রহস্য আছে, যে কারণে কেবল ব্যবসায়ীরা নন, সব অঙ্গনের লোকজনই এমপি হতে চাইছেন?

এরশাদ সরকারের সময় বেইলি রোডে একটা নাটক মঞ্চস্থ হতো—'বাবা আমি মন্ত্রী হবো'। স্বৈরশাসনের সেই চাপে ও তাপে সবাই কেবল মন্ত্রী হতে চাইত। কারণ, একবার মন্ত্রী হলেই তার আর কিছু লাগে না। এমনকি কয়েক প্রজন্মের আখের গোছানো হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি সেই সময় থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছে, কোনো অর্জন হয়েছে?

সবার এমপি হতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে এটাও পরিষ্কার ও স্পষ্ট যে, আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, আইনপ্রণেতা পদটির যথেষ্ট কৌলীন্য ও যথাযোগ্য মর্যাদা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এক্ষেত্রে আমাদের যেমন দায় রয়েছে, তারচেয়েও অধিক দায় রয়েছে রাজনীতিবিদদের।

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এ দেশে বা এই উপমহাদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রারম্ভটা হয়েছে যাদের প্রযত্নে-হাত ধরে, তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সময়ের জন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—সবাই মুখ্যত রাজনীতিবিদ ছিলেন।

কেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান আমলের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই আইনজীবী ছিলেন? কারণ, আইনজীবীরা দেশটাকে বুঝতেন-দেশের মানুষগুলোকে বুঝতেন। জানতেন যে তাদের কী করতে হবে, সময়ের দাবি অনুযায়ী, জনগণের প্রত্যাশামতো কী করা দরকার। আদালতে গেলেই, আদালত পাড়ায় ওঠাবসা করলেই বোঝা যায়, কেমন আছে দেশ, কেমন আছে দেশের মানুষ। আর একটা জায়গা হলো হাসপাতাল, সেখানেই স্পষ্টভাবে হাজির থাকে কেমন আছে একটা দেশের বাসিন্দারা, কী তাদের হাল-হকিকত।

সময় যত গড়িয়েছে, রাজনীতিতে অরাজনীতিবিদদের প্রভাব ও প্রতাপ তত বেড়েছে। এটা কি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, সময়ের দাবি, নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রের মানুষদের ডায়নামিক বা বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী হয়ে ওঠার বাস্তবতা? এসব নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। গবেষণা প্রয়োজন। সংলাপ ও তর্ক জারি রাখা প্রয়োজন।

মনে রাখা দরকার যে, কোকিল কেবল বসন্তেই ডাকে। আমাদের জীবন কিন্তু এক ঋতুতে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদেরকে বসন্তে যেমন বেঁচে থাকতে হয়, তেমনি গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীতেও জীবনধারণ করতে হয়। এ কারণে কেবল বসন্তে নয়, যে পাখি সব ঋতুতে পাশে, থেকে তাকে বা তাদেরকে বেশি প্রয়োজন।

যারা এমপি হতে চান, তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। কেবল এটুকু বলা যে, রাজনীতিবিদরা, ব্যতিক্রমী উদাহরণ বাদে, যেকোনো পেশাজীবীর চেয়ে জনগণকে ভালো বোঝেন, জনগণের চাওয়া-পাওয়াটা আমলে নেন। এ কারণে রাজনীতিটা তাদেরকেই মানায়। আপনাদেরকে যেমন মানায় অন্যক্ষেত্রে।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments