ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি: কী হবে কাল?

স্টার ফাইল ফটো

বিচারপতিদের অপসারণ-সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত (আপিল বিভাগ) যে রায় দিয়েছিলেন, তা রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিল বিগত সরকার—যার ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে আগামীকাল রোববার (২০ অক্টোবর)।

রিভিউয়ে রায় পরিবর্তন হয় কি না—সেটি অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। যেমন: সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ফিরিয়ে আনতেও আবেদন করা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে দেশের পাঁচজন নাগরিক রিভিউ আবেদন করেন। এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষেও গত ১৬ অক্টোবর রিভিউ আবেদন করা হয়—যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে বিএনপি ১০টি যুক্তি দিয়েছে। এটিও রোববার আপিল বিভাগে উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

সেই হিসেবে ভবিষ্যতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশের সংবিধান ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন হিসেবে হয়তো উল্লিখিত হবে।

প্রসঙ্গত, বিচারপতিদের পদত্যাগ বা অপসারণে দেশে এ মুহূর্তে কোনো আইন নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদ বদলে দিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে দেন।

সরকার এই রায় রিভিউয়ের আবেদন করে। সুতরাং রিভিউতে রায়টি বাতিল হলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে আগের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত হবে, নাকি অন্য কোনো নির্দেশনা আসবে—সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা কঠিন।

বাহাত্তরের মূল সংবিধানে বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থের প্রমাণ পেলে এবং সংসদের মোট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলে রাষ্ট্রপতির আদেশে ওই বিচারককে অপাসরণ করা যাবে।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীও কার্যত অচল হয়ে যায়। কেননা ওই সংশোধনীর মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল সেটি বাতিল হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাও আর রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে না।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সংসদ ভেঙে দিলে প্রশ্ন ওঠে, যদি সংসদ না থাকা অবস্থায় কোনো বিচারককে অপসারণের প্রয়োজন দেখা দেয় বা কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগের তদন্তের প্রয়োজন হয়; আবার সংসদ থাকা অবস্থায় যদি দুই-তৃতীয়ংশ সদস্যের সম্মতি না পাওয়া যায়, তাহলে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি কিভাবে মীমাংসা হবে?

এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালের ২৭ নভেম্বর সামরিক ফরমান বলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করেন জিয়াউর রহমান; পরে যা পঞ্চম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

দীর্ঘদিন এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। এমনকি ২০১১ সালে যখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের আদি সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনাসহ সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়, তখনও বিচারপতিদের অপসারণ-সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে হাত দেওয়া হয়নি। বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে (২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল) বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তখনও বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত রাখার পক্ষেই ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর পরেও জিয়াউর রহমানের আমলে করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকে।

কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় এর পরের বছরই। অর্থাৎ ২০১২ সালে হাইকোর্টের একটি আদেশ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে।

কী হয়েছিল নবম সংসদে?

২০১২ সালের ১৪ মে সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ ওই বছরের জুনের মধ্যে হাইকোর্ট সংলগ্ন সড়ক ভবনের একটি অংশ এবং দুটি কক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এ আদেশের বিষয়টি সংসদে উত্থাপিত হলে তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ ২৯ মে সংসদে বলেন, 'দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে, আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।'

এর প্রতিক্রিয়ায় ৫ জুন হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ স্পিকারের এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এবং স্পিকারের বক্তব্যেকে 'রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক' বলে অভিহিত করেন। এমনকি এই বক্তব্যের কারণে স্পিকারের পদে থাকার অধিকার নেই বলেও হাইকোর্ট মন্তব্য করেন।

আদালতের এই মন্তব্যের পর ওইদিন সন্ধ্যায় সংসদে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সরকার দলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানান। আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীকে 'স্যাডিস্ট' বলেও মন্তব্য করেন।

এ ঘটনার রেশ ধরেই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনার পরে বিচারপতিদের অপসারণ বা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুরাহা করার জন্য একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিল সরকার। যেখানে বিচারকের অপসারণের একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়। যদিও সেখানে কোনো বিচারপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও দীর্ঘ। এমনকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়েও।

অর্থাৎ বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হলেও এই আইনে সংসদের একচ্ছত্র ক্ষমতা রাখা হয়নি। বরং বলা হয়, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সংসদ সদস্যরা প্রাথমিক তদন্ত করবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেটি যাবে তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে। সেই কমিটি যদি অভিযোগের সত্যতা পায়, তখন সেটি সংসদে উঠবে ভোটের জন্য। আবার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলেই কেবল সেটি অনুমোদিত হবে।

তবে ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী (রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন) স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এই যুক্তিতে অবৈধ ও বাতিল বলে প্রথমে (২০১৬ সালের ৫ মে) রায় দেন হাইকোর্ট, পরে (২০১৭ সালের ৩ জুলাই) আপিল বিভাগও এটি বহাল রাখেন—যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ওই বছরের ১ আগস্ট।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সংসদ সদস্যরা বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের বিধান ফিরিয়ে এনেছিলেন একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। আবার এই সংশোধনী বাতিল করে দেওয়ার ঘটনাপ্রবাহে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশও ছাড়তে হয়।

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় পাঁচ মাস পর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার ওই রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়। আবেদন জমা দেওয়ার পর তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আবেদনে ৯৪টি গ্রাউন্ড পেশ করা হয়েছে। দুই মাস নিরলস শ্রম দিয়ে একটি আইনজীবী প্যানেল এই আবেদন প্রস্তুত করেছে। যদিও দীর্ঘদিনেও এই রিভউ আবেদনের ওপর শুনানি হয়নি।

কোনো রায়ের রিভিউ শুনানি কতোদিনের মধ্যে হতে হবে, তার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রিভিউ শুনানি হবে কী না, সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে যারা রিভিউ চেয়েছেন, তাদের ওপর। তারা যদি আদালতকে বলেন যে, তারা এটার শুনানি করতে চান, সেক্ষেত্রেই রিভিউ হতে পারে। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রিভিউ শুনানি করেন না। আবার আপিল বিভাগের যে সংখ্যক বিচারকের বেঞ্চ ওই রায় দিয়েছেন, রিভিউ শুনানিতে সেই সংখ্যক বিচারকই থাকতে হবে, এমনও বাধ্যবাধকতা নেই।

কী হবে কাল?

রোববার ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানিতে কী হবে—সে বিষয়ে অগ্রিম মন্তব্য করা অনুচিত। কেননা এটি পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার। তবে উচ্চ আদালতের বিচারকরা (যারা মূলত বিচারপতি নামে অভিহিত হন) তাদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হওয়ায় যে অসন্তুষ্ট—তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তাছাড়া বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা, তথা বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় স্থাপনের দাবিও দীর্ঘদিনের।

বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদও বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আলাদা সচিবালয় স্থাপন করা হবে—যা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পরিচালিত হবে। বিচারকদের পদায়নের জন্য পৃথক নীতিমালা করা হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নিয়ম করতে হবে। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় ছাড়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। (সমকাল, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪)

রোববার রিভিউ শুনানির পরেই এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত রায় বা সিদ্ধান্ত দেবেন, নাকি এ বিষয়ে দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীদের মতামত জানার জন্য অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেবেন—সে বিষয়ে আগাম মন্তব্য করা কঠিন। তবে ধারণা করা যায়, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে যেহেতু আগের সরকার নেই এবং এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে রয়েছে, ফলে রিভিউয়ের আবেদনকারী হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ হয়তো এই মামলাটি নিয়ে এগোবে না। সেক্ষেত্রে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টিই বহাল থাকতে পারে।

আর এই রায় বহাল থাকলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকবে না। বরং এটি হয় আগের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে চলে যাবে, অথবা এমনও হতে পারে যে, সর্বোচ্চ আদালত নতুন কোনো নির্দেশনাও দিতে পারেন।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

US election: What is at stake for Bangladesh’s export

As millions of Americans head to the polls on November 5 to vote for either Democratic Vice President Kamala Harris or her Republican rival Donald Trump, apparel business communities in Bangladesh, more than 13,119 kilometres away from Washington, will be watching the results of the presidential election closely.

12h ago