রোহিঙ্গা ইস্যুতে গুতেরেস কী বার্তা দিয়ে গেলেন?

এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত

চারদিনের সফরে এসে গত ১৪ মার্চ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় এক লাখ মানুষের সঙ্গে ইফতার করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে তারা কাজ করবেন।

এটি নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি আদৌ বাস্তবসম্মত কি না?

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) হিসাবে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ পাঁচ হাজার ৫২০ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১২ লাখ। সরকারি হিসাবে ১০ লাখ ধরলেও এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আগামী এক বছরের মধ্যে কি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে?

যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকই মনে করে না, তারা তাদেরকে কেন ফেরত নেবে? বাংলাদেশ বা জাতিসংঘ কি তাদের ওপর এমন কোনো চাপ প্রয়োগ করতে পারবে বা এমন কোনো কৌশল কি জাতিসংঘের আছে, যার মাধ্যমে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার ফেরত নেবে? যদি থাকতো, তাহলে এতদিনে অন্তত হাজার দশেক রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতো! কিন্তু নেয়নি।

বছরের পর বছর এই সংকট নিয়ে কথা হয়েছে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন  আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশ কথা বলেছে, এমনকি রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে গাম্বিয়ার মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধসহ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার সেসব কথায় থোড়াই কেয়ার করেছে।

সুতরাং, মি. গুতেরেস ও ড. ইউনূসের এই আশাবাদ আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

বাস্তবতা হলো, আগামী এক বছরে যদি বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ মিলে অন্তত লাখখানেক রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারে, সেটিও বড় কাজ হবে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সেটিও অসম্ভব। কেননা, মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন চালিয়ে আসছে, সেই যুক্তি থেকে তাদের ফেরানো কঠিন। হয় তাদের মধ্যে শুভবোধের উদয় হতে হবে, না হয় তাদের ওপর এমন কোনো চাপ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক মর্যাদা দিয়ে ফেরত নেয়। কেননা, মিয়ানমারে তাদের ফেরত নেওয়াটাই সমাধান নয়। সেখানে ফেরত গিয়ে যদি এই জনগোষ্ঠীর মানুষ যদি আবার হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের মতো অপরাধের মুখোমুখি হয়, তাহলে সেই প্রত্যাবাসন অর্থহীন।

তাছাড়া রোহিঙ্গাদের মূল ভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও আশেপাশে চীনের বিনিয়োগ থাকায় এবং সেখানে ভারতেরও নানাবিধ স্বার্থ থাকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুটি দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের যে ধরনের সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিল, তা পাচ্ছে না। উপরন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ভালো। সুতরাং এতসব সমীকরণের মধ্যে জাতিসংঘ সত্যি সত্যিই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারবে—সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে সতর্ক করেছে, তহবিল সংকটের কারণে আগামী মাস থেকে মিয়ানমারের ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে জরুরি খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে করে মিয়ানমারজুড়ে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে।

সংস্থাটি বলছে, এই সহায়তা কমার ফলে মধ্য রাখাইনের প্রায় এক লাখ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যাদের সহায়তা ছাড়া খাবার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর মধ্যে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারাও রয়েছে। একই সময়ে ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, তহবিল সংকটের কারণে এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যের বরাদ্দও অর্ধেকে নামতে পারে। তাতে প্রতি বেলায় তাদের জন্য মাত্র ৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে।

প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারের ১০ লাখের বেশি মানুষ যদি খাদ্য সংকটে পড়ে, সেই বাস্তবতায় দেশটি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আদৌ রাজি হবে কি? তাছাড়া তারা কোন চাপে এই মানুষগুলোকে ফেরত নেবে? জাতিসংঘের মেকানিজম কী হবে? এ বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো রোডম্যাপ আছে? না থাকলে, প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার সামনে জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্ত করা আশাবাদ কি কেবল মন ভুলানো কথা? তারা নিজেরাও কি বাস্তবতা জানেন না?

এই সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন ও তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ জরুরি। ১৫ মার্চ ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'মিয়ানমারে লড়াই বন্ধ করা ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হবে সহিংসতা বন্ধ করা এবং একই সঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা, যা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করবে—যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে।'

গুতেরেস আরও বলেন, 'আমাদের মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।' বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের জন্য একটি মানবিক সহায়তা চ্যানেল তৈরির সম্ভাবনা কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটি স্পষ্টতই এমন একটি বিষয়, যা অনুমোদন ও সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।'

এখানে কয়েকটি প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি—

১. আরাকান আর্মি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা রাখাইন রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন তথা আলাদা আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সুতরাং জাতিসংঘ মহাসচিব তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পরামর্শ দেওয়ার মধ্য দিয়ে কি এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিলেন?

২. রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা ও সমঝোতা করার কথা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে। একটি বৈধ সরকার কি কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করতে পারে? বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ শুরু করে সেটিকে মিয়ানমার সরকার কীভাবে নেবে? এই ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অবনতি হবে কি না?

৩. জাতিসংঘ মহাসচিব কি স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার সংস্থার অনানুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়ে গেলেন?

৪. যদি রাখাইনে আলাদা রাষ্ট্র হয়, সেটি কি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে? এরইমধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের পুরোটা আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। তারা যদি সত্যি সত্যিই রাখাইনে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়, তখন সেই রাষ্ট্রে বাংলাদেশ সীমান্তের কোনো অংশ তাদের রাষ্ট্রের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাংলাদেশ কী করে ঠেকাবে? আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধ করবে? তখন জাতিসংঘের অবস্থান কী হবে?

৫. শোনা যায়, বঙ্গোপসাগর বিধৌত এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ মহাসচিব কি সেই বার্তাটিও দিয়ে গেলেন?

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

10h ago