ইভিএমে কেন ১৫০ আসনে নির্বাচন
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অনূর্ধ্ব ১৫০ আসনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
গত ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক ও সাংবাদিকসহ অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। তাদের বেশিরভাগই ইভিএমের বিপক্ষে বা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসেছে। তাদের মধ্যে ১০টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে। দলগুলো হচ্ছে—জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)।
সংলাপে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীক ৩টি দল— বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। এর মধ্যে তরিক ফেডারেশন ১৫০ আসনে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে।
সংলাপে অংশ নেওয়া ২৮ দলের মধ্যে ২টি দলের ইভিএম নিয়ে কোনো মতামত নেই। আর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদসহ ১২টি দল শর্তসাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহার করা যায় বলে মত দিয়েছে।
আর বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। এই ৯টি দলের অবস্থানও ইভিএমের বিরুদ্ধে। দলগুলো হলো—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন।
বর্তমান ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথমত, নির্বাচন কমিশন যে ইভিএমে ভোট নিতে চাচ্ছে, নিয়মটা বেশিরভাগ ভোটারের তো মেনে নিতে হবে। এবার ১০ কোটি ভোটার আছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন সংলাপটা কেন করল? এর থেকে কী আহরণ করল? এই নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর তারা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসেছে। আমি যতটুকু জানি, তাদের বেশিরভাগই ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।'
'বর্তমান ইভিএম নিয়ে আমারও কারিগরি সংশয় আছে। এই ইভিএম নিয়ে চাইলে কোনো কেস করা যাবে না। কারণ, এর কোনো ভিভিপিএটি নেই। ব্যালট পেপারে ভুয়া ভোট হয়েছে কি না, গণনাতে কারচুপি হয়েছে কি না, এগুলো বের করার অনেক উপায় আছে। ইভিএমে যা সম্ভব না। এই কারণে ভারতে ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করেছে', বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু, সেই ব্যবস্থা না করে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণায় যেটা হবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারবেন না। কারণ, ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলাতেই সময় পার হয়ে যাবে। এই কারিগরি ত্রুটি ছোট নয়, বেশ বড়। একটা জাতীয় নির্বাচনে ১৫০ আসনে যদি ইভিএমে ভোট নিতে চায়, তাহলে অন্তত ২ লাখ বুথ প্রয়োজন, ২ লাখ ইভিএম প্রয়োজন, সবকেন্দ্রে কারিগরি বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। কোনো মেশিন হ্যাং করলে তা ঠিক করতে বিকেল হয়ে যাবে। জাতীয় নির্বাচনে এই ঝুঁকি তারা কেন নেবেন, যেখানে তাদের প্রতিই এখনো মানুষের আস্থা নেই?।'
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, 'ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা করা যাবে না। যদি কোনো প্রার্থী চ্যালেঞ্জ করেন, নির্বাচন কমিশন সেটা কীভাবে প্রমাণ করবে যে গণনা ঠিক আছে? ইভিএমে ভোট নেওয়া হলে বুথ ক্যাপচার করাটাও সহজ হয়ে যাবে। অনেকে বলেন, ইভিএমে ব্যবহার করা কেন্দ্রে গোপন কক্ষে একজন বসে থাকেন। হয়তো শহরে এটা হয় না। জালিয়াতি তো আর ৩০০ আসনের প্রতিটি বুথেই হয় না।'
এই নির্বাচন কমিশনের ওপর তার অনেক আশা ছিল জানিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'এ পর্যন্ত যা দেখলাম, তাতে নিরাশ হয়েছি। কারণ, এতগুলো দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা তারা দিলেন। সরকারি দল তো চাইবেই। কিন্তু, ইভিএম নিয়ে যে সংশয়গুলো আছে, সেগুলোর কোনো সমাধান হলো না, সেগুলো দূর করা হলো না।'
ইভিএম নিয়ে আস্থার সংকট আছে বলে মনে করেন করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের অনেকেই ইভিএম নিয়ে তাদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন কমিশন সেই অনাস্থা দূর না করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ভয়ানক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। পক্ষান্তরে তারা বলার চেষ্টা করছে, ইভিএমের প্রতি আস্থা রাখার বিষয়টি প্রমাণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না। অথচ, ইভিএম নির্ভরযোগ্য যন্ত্র কি না, এটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে কি না, এটা পেপার ব্যালট থেকে ভালো কি না, সেটা প্রমাণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা তো তাদের দায়িত্ব।'
তিনি বলেন, 'প্রযুক্তিগতভাবে যে ইভিএম একটা নিম্নমানের যন্ত্র, সেটা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলে গিয়েছেন। কারণ, এটাতে কোনো ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল) নেই। ফলে একবার ফল প্রকাশ করা হলে তা যাচাইয়ের আর সুযোগ নেই। অর্থাৎ ইভিএমকে বিশ্বাস করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতাই এখন বড় প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনই অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে তাদের কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি করেছিল। কিন্তু, ইভিএম কেনার বিষয়ে তিনি সই করেননি। প্রযুক্তিগত বিষয়ে ইভিএমের যে সীমাবদ্ধতা আছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিবিদ তো সেটা বলেই গিয়েছেন।'
বায়োমেট্রিক নির্ভর হওয়ায় অনেক ভোটারকে ইভিএম শনাক্ত করতে পারে না উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'সাবেক সিইসি নুরুল হুদাসহ অনেকেরই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইভিএম শনাক্ত করতে পারেনি। এই কারণে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় ওভাররাইট করার। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোটারের জন্য এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এটা কেউ জানে না। ২৫ শতাংশ ভোট যদি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে তারা যেকোনো ফলাফল তৈরি করতে পারবেন। ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতি করা যায়।'
'ইভিএম সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত। চাইলে সফটওয়্যার ম্যানিপুলেট করে যেকোনো ফলাফল তৈরি করা যায়। নির্বাচনের সময় যেসব কারিগরি কর্মকর্তাকে মাঠে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারা চাইলে যেকোনো কিছু করতে পারেন। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চট্টগ্রামে ২ বার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এটা তো জালিয়াতি ছাড়া সম্ভব না', বলেন তিনি।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সুজন সম্পাদক বলেন, '৬টি আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ায় ৩০ শতাংশ ভোট কমে গিয়েছিল। গত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও ৫ শতাংশ ভোট কমে গিয়েছিল। যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে ভোটার বাড়ানোর জন্য, সেটার কারণেই ভোট কমছে। ইভিএম ব্যবহার থেকে উন্নত দেশগুলোও সরে আসছে। কাজেই মানুষের আস্থাহীনতা দূর না করে ইভিএম ব্যবহার অযৌক্তিক। ইভিএম ব্যবহার হলে আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা ইতোমধ্যেই বিপদের মধ্যে আছি, ইভিএম ব্যবহার হলে তা আরও ভয়ানক বিপদের দিকে ঠেলে দেবে এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতা আরও বাড়বে। এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক যে জাতীয় সংকট তৈরি হয়ে গেছে, সেটাকে আরও উসকে দেবে।'
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদের মত ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু, ইভিএমের ক্ষেত্রে দুটি জায়গায় মোডিফিকেশন দরকার বলে তিনি জানান। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'প্রথমত, ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা দরকার। এতে ভোটার ভোট দেওয়ার পর একটি কাগজ (প্রিন্ট করা) বেরিয়ে আসবে। ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা থাকবে। কাগজটি ইভিএমের পাশে একটি বাক্সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে। ফলে, কেউ ভোটগণনা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে এর মাধ্যমে পুনর্গণনা করা যাবে। ভারতে আদালতের আদেশে ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়েছে।'
'দ্বিতীয়ত, আমাদের ইভিএমে দুইটি অংশ থাকে। একটি ভোটার আইডেনটিফিকেশন ইউনিট, আরেকটি ব্যালট ইউনিট। ভোটার আইডেনটিফিকেশন ইউনিটে ভোটার আইডেনটিফাই হলো। কিন্তু, ব্যালট ইউনিটে আর ভোটার আইডেনটিফিকেশন হয় না। ফলে একজন ভোটার ইভিএমে আইডেনটিফিকেশন করে ফেলার পর অন্য যে কেউ ব্যালট ইউনিটে চাপ দিয়ে ভোট দিয়ে দিতে পারছে। এতে করে ভোটার আইডেনটিফাই হওয়ার পর তাকে বের করে দিয়ে অন্য কেউ ভোট দিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকছে। স্থানীয় নির্বাচনে দেখা গেছে, ইউপি সদস্যের জন্য ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন, কিন্তু, চেয়ারম্যানেরটা তাদের দিতে দেয়নি। সুতরাং ইভিএমে ভোটার আইডেনটিফিকেশনের মতো ব্যালটেও আইডেনটিফিকেশন থাকতে হবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, একই লোক ভোট দিচ্ছে। তাহলে ইভিএম মেশিন বিশ্বাসযোগ্য হবে', বলেন তিনি।
তোয়াফেল আহমেদ আরও বলেন, 'আরেকটা বিষয় হলো কেন্দ্রে কেন ভোটাররা এখন আসছে না? বিগত বছরে একটা জিনিস হয়েছে, সরকারি দল জরিপ করে বের করেছে যে, কে তাকে ভোট দেবে, কে দেবে না। তারা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করছে যেন, যারা তাকে ভোট দেবে না, তারা যেন কেন্দ্রে না যায়। যদি যায়ও, তাহলে তাকে ওয়াচ করছে এবং তার পেছনে কেন্দ্রে ঢুকে পড়ছে। এটা থেকে মুক্তি পেতে হলে একটা বৃহৎ উদ্যোগ দরকার। সেটা হলো পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি চালু করা। আমাদের প্রায় ১ কোটি ভোটার দেশের বাইরে থাকেন। আবার অনেকে এক এলাকার ভোটার, কিন্তু, বর্তমানে থাকছেন অন্য এলাকায়। তারা তো ভোট দিতে পারছেন না। তাদের জন্যও এই পদ্ধতি দরকার।'
'যারা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের জন্য পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি চালু আছে। কিন্তু, এটা সবার জন্য করতে হবে। এটাতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এতে করে ভোটের হার বাড়বে', বলেন তিনি।
Comments