প্রতিশ্রুতি না রাখার ১ বছর: শাবিপ্রবির উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন
প্রায় ১ বছর আগে উপাচার্যের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবিতে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যে ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায়, তার প্রধান দাবিই এখনো পূরণ হয়নি।
শাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এখনো নিজ পদে বহাল আছেন। প্রত্যাহার হয়নি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১টি মামলা।
আন্দোলনে পুলিশের শটগানের গুলিতে মারাত্মক আহত শিক্ষার্থী সজল কুণ্ডু শরীরে ৭০টির বেশি স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছেন। চিকিৎসার খরচ জুটছে না তার। তাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করেনি কর্তৃপক্ষ; বরং তার চলার সম্বল ক্যাফেটেরিয়াটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গত ১ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে একটি ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে। আন্দোলনে ও অনশনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে হয়রানি করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর বিভাগে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে বিএনসিসির এক ক্যাডেটের ক্যাডেটশিপ।
উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার (ড. জাফর ইকবাল) আমাকে বললেন, আমি যখনই কথা বলি ওরা (সরকারের উচ্চপর্যায়) বলে যে ওরা (পদত্যাগের বিষয়ে) কাজ করছে, হয়ে যাবে। আমি দেখি তারপরও ওরা আবার একই কথা বলে।
এমনকি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করায় ওই শিক্ষার্থীকে গণপিটুনি দেওয়ার হুমকির অভিযোগও এসেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে।
এই আন্দোলন চলাকালীন উপাচার্যের পদত্যাগসহ অন্যান্য দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুরোধে অনশনরত ২৮ শিক্ষার্থীর ১৬৩ ঘণ্টার অনশন ভাঙিয়েছিলেন শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, এখন ড. জাফর ইকবাল তাদের বলছেন, 'আমাকে তো তারা (সরকারের উচ্চপর্যায়) কথা দিয়েছিল। এখন কেন এমন করছে বুঝতে পারছি না।'
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ড. ইয়াসমিন হকের মুঠোফোনে ২ দিনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে বক্তব্যের বিষয় উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কথা বলা সম্ভব হয়নি ড. জাফর ইকবালের সঙ্গেও। গত ৪-৫ দিনে তাকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়েছে, এসএমএস পাঠানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্তও তিনি সাড়া দেননি। তার ব্যক্তিগত সচিব জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে ড. জাফর ইকবালের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে তার মন্তব্য জানাবেন। কিন্তু তিনিও কিছু জানাননি। গত সোমবার জয়নাল আবেদীনকে আবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আন্দোলনের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ জানান যে, এদিনই (সোমবার) তার সঙ্গে ড. জাফর ইকবালের কথা হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারকে রাজ বলেন, 'উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার আমাকে বললেন, "আমি যখনই কথা বলি ওরা (সরকারের উচ্চপর্যায়) বলে যে ওরা (পদত্যাগের বিষয়ে) কাজ করছে, হয়ে যাবে। আমি দেখি তারপরও ওরা আবার একই কথা বলে।"'
উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও ক্যাম্পাসে ভয়ের পরিবেশ তৈরির অভিযোগ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে শাবিপ্রবির ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক আমিনা পারভীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো ছাত্র এরকম কোনো বিষয় আমাকে অবগত করেনি, তাই এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই।'
তার ভাষ্য, আন্দোলনের পর প্রথমদিকে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে। এক্ষেত্রে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে বলে তিনি জানেন না।
গুলিতে আহত সজল কুণ্ডুর একার লড়াই
সম্প্রতি শাবিপ্রবির উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের পূর্বাপর নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন সে সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত সজল কুণ্ড ও আন্দোলনের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ।
গত ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করেন, তখন পুলিশের গুলিতে আহত হন সজল কুণ্ডু।
এর প্রায় ২ সপ্তাহ আগে থেকে সজল এই ভবনের ক্যাফেটেরিয়াটি চালাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ৫ দাবির ভেতর সজলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের পাশাপাশি তাকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ও তার 'যোগ্যতা অনুসারে' একটি চাকরি দেওয়া দাবি ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। উপরন্তু তার কাছ থেকে আইআইসিটি ভবনের ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্বও কেড়ে নিয়েছে প্রশাসন।
আন্দোলনের পর প্রথমদিকে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে। এক্ষেত্রে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে বলে আমি জানি না।
সজল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি এই বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি পাবনার ফরিদপুর উপজেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ২ ভাই-বোনের মধ্যে বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে মা একাই থাকেন।
সজল জানান, জীবনধারণের জন্য মায়ের আয় যথেষ্ট না হওয়ায় সজল মাকে সহযোগিতা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষ থেকে তিনি পড়ালেখার ফাঁকে টিউশনিসহ বিভিন্ন কাজ করে আসছেন। মাকেও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার আগে খাবার বিক্রির ব্যবসা চালু করেন তিনি। আন্দোলনের আগে ২ জানুয়ারি ওই ব্যবসা বন্ধ করে ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব নেন।
সজল বলেন, 'শরীরে স্প্লিন্টারগুলো থেকে যাওয়ার কারণে আমার নানা ধরনের শারিরীক সমস্যা হয়। যেমন- আমার লাংসের কাছে ২টি স্প্লিন্টার থেকে গেছে। এ জন্য মাঝে-মাঝেই আমার দম আটকে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমার ডান হাতে আর আগের মতো বল পাই না। গ্রিপ করতে পারি না। ২ কেজি ওজনের কিছুও তুলতে পারি না।'
সজলের ভাষ্য, 'সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমরা প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের দাবিগুলো পূরণ করা হবে। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। উপরন্তু আমার সঙ্গে সবচেয়ে যে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঘটেছে তা হলো, একটি যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানানোর কারণে আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ক প্রশাসক বিভিন্ন নিয়ম-কানুন দেখিয়ে ক্যাফেটেরিয়াটি বন্ধ করে দেয়।
'আমার অপারেশন হয় ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে। অপারেশনের পর সপ্তাহখানেক ঢাকায় থেকে আমি পোস্ট ট্রিটমেন্ট নেই। পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আমি ক্যাফেটেরিয়াটি পুনরায় চালু করি। এভাবে আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিলাম। অনেক ধারদেনা করে আমি এখানে দ্বিতীয়বারের মতো বিনিয়োগ করেছিলাম।'
হেনস্তা-হয়রানি
সজল আরও বলেন, 'দ্বিতীয়বারের মতো ক্যাফেটেরিয়া চালুর কিছুদিনের মধ্যে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকদের সঙ্গে আমার একটি সুসম্পর্ক ছিল, তারা কারণে অকারণে বিভিন্নভাবে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলেন। নতুন নতুন বিধি-নিষেধ, নিয়ম কানুন আরোপ হতে শুরু করল। কথায় কথায় আমাকে তারা বলতে শুরু করলেন, "তুমি তো এখানে থাকতে পারবা না।"'
সজলের ভাষ্য, আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে তার সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমি তখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আমার এক হাতে ক্রাচ, আরেক হাতে অপারেশনের ব্যান্ডেজ। তখনো সেলাই কাটা হয়নি। এ অবস্থায় আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিস রুমে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। পান থেকে চুন খসলেই বিভিন্নভাবে আমাকে চার্জ করা হতো। সব সময় একটা আতঙ্কে থাকতাম এই বুঝি আমাকে কেউ বকতে শুরু করবে।'
আন্দোলনের সম্মুখসারিতে যারা ছিল তাদের ধরে ধরে মার্ক করে অ্যাকাডেমিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অনশনকারী একজনকে বলা হয়েছে, ওদের রিসার্চ গ্রুপে ওকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বিএনসিসির একজনের ক্যাডেটশিপ বাতিল করা হয়েছে।
সজল বলেন, 'আমি মার খেলাম, গুলি খেলাম, মানসিক নির্যাতনের শিকার হলাম, যথার্থ চিকিৎসা দেওয়া হলো না, অপারেশনের পর পোস্ট ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে কেউ এগিয়ে আসল না, অথচ এর সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বয় করার কথা ছিল। একটা চাকরি দেওয়ার কথা ছিল, সেটাও দেওয়া হলো না। উল্টো আমার পেটে লাথি মেরে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এখন পরিবারকে সাহায্য করা দূরের ব্যাপার, নিজের ওষুধ কেনার পয়সাও নেই আমার কাছে।'
আন্দোলন স্থগিত হওয়ার ৭-৮ মাসের মাথায় দাবি আদায়ে গুলি খাওয়া সজল কুণ্ডু আবার একাই প্রতিবাদে অংশ নিতে শুরু করেন। ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া, সাবেক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার ও নিজের চাকরির দাবিতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবনের সামনে। তখন তার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বলে জানান সজল। বলেন, 'সেই কমিটি থেকে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তারাও আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল আবারও। এবারও তারা সেই কমিটমেন্ট ব্রেক করেছে।'
এসব বিষয়ে গত ৩১ ডিসেম্বরও ডা. জাফর ইকবালের সঙ্গে তার কথা হয়েছে জানিয়ে সজল বলেন, 'স্যার খালি একটা কথাই বলেন, "আমাকে তো তারা কথা দিয়েছিল। এখন কেন এমন করছে আমি বুঝতে পারছি না।"'
আন্দোলনের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজের বক্তব্য
এ ব্যাপারে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, 'দাবি আদায়ে আমাদের যে সহযোদ্ধারা অনশনে ছিল তাদের নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সে সময় আমরা নিজেরাও ওদের অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেছি। সেটাও ওরা শোনেনি। এমন পরিস্থিতিতে (২৬ জানুয়ারি) জাফর ইকবাল স্যার ও ইয়াসমিন ম্যাডাম এসে আমাদের এক প্রকার উদ্ধারই করেছিলেন এমন একটি পরিস্থিতি থেকে।'
এর পরের দিন ২৭ জানুয়ারির ঘটনাক্রম বর্ণনা করে রাজ বলেন, 'পরের দিন আমরা স্যারের সিলেটের বাসায় বসি। সেখানে একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। ইয়াসমিন ম্যাডাম ছিলেন। আমরা কয়েকজন ছিলাম। ওখানে আমরা খুঁটিনাটি সবকিছু জিজ্ঞাসা করছিলাম যে কী প্রক্রিয়ায় (ভিসিকে) সরানো হবে। তখন আমাদের সামনে বসেই জাফর স্যার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন এ ব্যাপারে। শিক্ষামন্ত্রী তখন এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিলেন না। তখন গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জাফর স্যারের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে বললেন, "তাকে (ভিসিকে) কী প্রক্রিয়ায় সরানো হবে সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা হয়েছে।" তখন তিনি (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) উদাহরণ হিসেবে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সরানোর উদাহরণ দেন।'
রাজ বলেন, 'উনি (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) আমাদের এভাবে বোঝালেন যে, বিষয়টাকে একটা উইন উইন সিচুয়েশনে রাখতে হবে সরকারের জন্য। সরকার চায় না এখনই ভিসিকে সরাতে। উনি বললেন, "আমরা বুঝতে পেরেছি যে তোমাদের আন্দোলন যৌক্তিক। সেহেতু একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে (ভিসিকে) আমরা সরাবো। ৩-৪ মাস লাগবে।"'
রাজের ভাষ্য, শিক্ষার্থীরা যাতে ভিসির পদত্যাগের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে, তার জন্য ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা শিক্ষামন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনে সেভাবে কথা বলার পরামর্শও দেন।
রাজ বলেন, 'এরপর শিক্ষামন্ত্রী প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন "আমরা ওদের (শিক্ষার্থীদের) সব কথা শুনেছি। ওদের কথা যৌক্তিক। আমরা এ ব্যাপারে (ভিসিকে সরানোর ব্যাপারে) পদক্ষেপ নিতে চ্যান্সেলরকে জানাবো।"'
হতাশার শুরু
রাজের বক্তব্য, দাবি পূরণের আশ্বাসের ব্যাপারে হতাশার শুরু এখান থেকেই। তিনি বলেন, 'এরপর থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের একই কথা বলা হচ্ছে যে, পরের মাসে হয়ে যাবে। তার পরের মাসে হয়ে যাবে। সবগুলো (দাবির) ব্যাপারে।
রাজ আরও বলেন, 'এগুলোর মধ্যে প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা অপসারণের দাবিটি মানা হয়েছে। বন্ধ ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও একটি এখনো বন্ধ আছে, যেখানে এখনো ৪০ হাজার টাকার মতো আছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে মামলাটি ছিল সেটি তোলা হয়েছে খুব সম্প্রতি।
'সিলেটের ৩টি হাসপাতাল মিলিয়ে আমাদের যে বকেয়া ছিল ওটা সরকারের পক্ষ থেকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সজলের চিকিৎসার জন্য পরে আর কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। ওর প্রথম অস্ত্রপচার পর্যন্ত ওরা (গোয়েন্দা সংস্থা) দেখেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, সজলসহ আহত অন্যদের বিষয়ে যখন ৪-৫ মাস পর আমি কথা বলতে গিয়েছি, তখন ওনাদের একজন আমাকে বলেছেন, "আমি বাকিদের ব্যবস্থা করছি, কিন্তু সজলেরটা না।" কারণ সজলের প্রতিবাদী ভাবমূর্তি ওদের পছন্দ না। আমাকে এটা অনেকবার বলা হয়েছে যে, "তুমি সজলকে থামাও। ওর মুখ বন্ধ করো। নাহলে ও কিন্তু কিছুই পাবে না।"'
দ্বিতীয় দফায় সজল দাঁড়ানোর পর আরেকটি দাবি পূরণ
এ ব্যাপারে রাজ বলেন, '৭-৮ মাস পার হওয়ার পর যখন আমরা দেখছি যে আর কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তখন সজল একরকম বাধ্য হয়ে একা দাঁড়ানো শুরু করল প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তখন আবার চারদিক থেকে ফোন আসা শুরু করল। এর আগ পর্যন্ত গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হলো, "তোমরা কেন এগুলো করছো। আমরা তো কাজ করছিই। এগুলো করলে তো আরও (দাবি পূরণে) দেরি হবে।"'
সজল দাঁড়ানোর পর খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলাটি তুলে নেওয়া হয় বলে জানান রাজ।
ড. জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক প্রসঙ্গে
রাজ বলেন, 'আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর থেকে আমি আমি কন্টিনিয়াস জাফর স্যার ও ইয়াসমিন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলি। কিছুদিন পরপরই। ৫-৬ মাস পর্যন্ত তারাও (উপাচার্যের পদত্যাগের ব্যাপারে) আশাবাদী ছিলেন। তাদেরও ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছিল। কিন্তু এখন জাফর স্যার বলছেন যে, "তোমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আরেকবার কথা বলো, বসো। আমি ব্যবস্থা করে দিবো।" ওই মুহূর্তে আমরা বসতে রাজি হইনি। কারণ আমাদের আগের (শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সভা) অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। এটা আমরা স্যারকে আগেও জানিয়েছি।'
এ বিষয়ে ১ মাস আগে (নভেম্বরের শেষ দিকে) ড. জাফর ইকবালের সঙ্গে কথোপকথনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাজ বলেন, 'তখন স্যার বললেন, "দ্যাখো আমি আমার মতো চেষ্টা করছি। তোমরা তোমাদের মতো চেষ্টা করো। কিন্তু তোমাদের যে আমি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বসতে বললাম, তোমরা তো রাজি হলে না।" আমরা কেন রাজি হয়নি সেটা আবার বলাতে স্যার বললেন, "আমি অ্যারেঞ্জ করে দিচ্ছি একজন মন্ত্রীর সঙ্গে বসার ব্যাপারে। কিন্তু তোমরা রাজি হচ্ছো না। এটা তো অ্যারোগেন্স।"'
রাজ বলেন, 'আমরা স্যারকে জানিয়েছিলাম যে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংয়ে কীভাবে আমাদের থ্রেট করা হয়েছে। পরে আমরা বলেছিলাম, "স্যার আপনি যদি থাকেন তাহলে আমরা বসব। একা যাবো না আমরা।" কিন্তু স্যার তাতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায় না পেয়ে স্যারকে ছাড়াই আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বসতে রাজি হই। কিন্তু স্যার ওই মিটিং এখনো অ্যারেঞ্জ করতে পারেননি।'
এখন রাজের আশঙ্কা, পুলিশ 'গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ' এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যে মামলাটি করেছিল, যেকোনো সময় প্রশাসন সেটি ব্যবহার করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের পরিবেশ
রাজ ও সজলের ভাষ্য, আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যাতে কেউ কিছু বলতে না পারে, কেউ কিছু করতে না পারে।
এ ব্যাপারে সজল বলেন, 'আন্দোলনের সম্মুখসারিতে যারা ছিল তাদের ধরে ধরে মার্ক করে অ্যাকাডেমিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অনশনকারী একজনকে বলা হয়েছে, ওদের রিসার্চ গ্রুপে ওকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বিএনসিসির একজনের ক্যাডেটশিপ বাতিল করা হয়েছে।'
রাজ বলেন, 'এছাড়া সম্প্রতি ভাইস চ্যান্সেলর (ফরিদ উদ্দিন আহমেদ) কোনো একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে আমাদের আন্দোলন নিয়ে একটি মন্তব্য করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে ভিসিকে গালমন্দ করে লেখে যে, তার মুখে কিছুই আটকায় না।
'এর দুই একদিন পর একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমাকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় যে আমি তাকে চিনি কিনা। পরে আমার কাছে তিনি জানতে চান, "ওকে যদি কেউ ধরে গণধোলাই দেয়, তাহলে কি তোমাদের কোনো সমস্যা আছে।"'
রাজের বক্তব্য, 'এর কারণ জানতে চাইলে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, "সে উচ্চপদস্থ লোকজনকে লোকজনকে গালাগালি করেছে।"'
রাজ বলেন, 'দিন দুয়েক পর আমরা শুনলাম, ওই ছেলের নামে প্রশাসন থেকে ওর ডিপার্টমেন্টে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ করে একটি চিঠি এসেছে। পরে আমরা এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এই সুপারিশ ডিপার্টমেন্ট অ্যাপ্রুভ করেনি। বোঝা গেল ওকে ভয় দেখানোর জন্যই ওরা এটি করেছে।'
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা।
এর জেরে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন।
সে ঘটনায় পুলিশ 'গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ' এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে ১৬ জানুয়ারি থেকে উল্টো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা অনশনে যান। উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
ওই আন্দোলনে শাহজালালে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠনও শাহজালালের শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
অবশেষে ২৬ জানুয়ারি শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জনপ্রিয় লেখক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইয়াসমিন হক।
উপাচার্যের পদত্যাগের ব্যাপারে তখন শাবিপ্রবির সাবেক এই ২ শিক্ষকের মাধ্যমে 'সরকারের উচ্চপর্যায়' থেকে শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাদা বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে পাঠানোর আশ্বাস দেন। তাদের অন্যান্য দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেন তারা।
Comments