আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি: যেমন কর্ম, তেমন ফল
প্রায় ১৫ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থেকে দলীয় আনুগত্যের নামে আওয়ামী লীগ যে সংস্কৃতিকে বেড়ে উঠতে দিয়েছে, তারই ফল এখন তারা ভোগ করছে। এর প্রকাশ ঘটছে ঔদ্ধত্য, আইনের প্রতি অসম্মান, ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে দেখার প্রবণতার মাধ্যমে। সার্বিক পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই প্রবাদ বাক্য, 'যেমন কর্ম, তেমন ফল'।
এসব কিছুর সূত্রপাত দলটিতে লালিত এক ধরনের ঔদ্ধত্যের মানসিকতা থেকে। সেটি হলো—যারা দলটির বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাদের কাছে কোনোভাবেই দেশের স্বার্থ প্রাধান্য পায় না এবং এ কারণে তারা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের 'শত্রু'। তাদের দেশপ্রেম অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। যারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তাদের মধ্যে ভালো কিছুই নেই, তাদের পুরোটাই মন্দ।
এমনকি, এই ধারণাও রয়েছে যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগেরই কেবল অধিকার রয়েছে দেশ শাসনের। স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ, মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা—তা যত কমই হোক না কেন—কখনোই পুরোপুরি পর্যালোচনা করা হয়নি, কিংবা এর স্বীকৃতি বা উপযুক্ত সম্মানও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি দৃষ্টিকটুভাবে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময় ফুটে উঠেছে। সবকিছু সব সময়ই যেন শুধুই আওয়ামী লীগের। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীল সংস্কৃতির জন্য যা উপযুক্ত হতে পারে না।
আশরাফুল হোসেনের (হিরো আলম) ওপর হওয়া সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাটিকেই বিবেচনা করা যাক। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে, এমনকি দলটির কোনো স্তর থেকেই হিরো আলমের ওপর হামলা চালানোর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। কিন্তু দলটির স্থানীয় ক্যাডাররা ভেবে নিয়েছেন, যে মানুষটি তাদের দলকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তাকে 'শিক্ষা দেওয়া' তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি তার মৌলিক অধিকার হলেও কিছু আসে যায় না।
দলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অসহিষ্ণুতার এই চর্চা এতটাই প্রকট হয়েছে যে, যেকোনো পর্যায়ের একজন ক্যাডার চাইলেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী থাকেন যে, এই হামলার জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে তো হবেই না, উল্টো এই 'সাহসী কাজের' জন্য প্রশংসা বা পুরষ্কারও পেতে পারেন।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ কর্মীরা ২৪ বছর বয়সী বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে, সেটা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। এই হত্যার ঘটনায় আদালত পরবর্তীতে ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের কথাও আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যরা তার ওপর নির্যাতন করেছিল। সেই নির্যাতন এতোটাই নির্মম ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলেছিল যে, শেষ পর্যন্ত আবরার মারা যান। পরবর্তীতে জানা যায়, বুয়েট ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটিকে 'টর্চার সেল' বানিয়েছিল। যে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও এর সিনিয়র নেতাদের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য দেখাতো না, তাদের এই 'টর্চার সেলে' এনে নির্যাতন করা হতো।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবরার হত্যায় জড়িত ছাত্রলীগের ১২ সদস্য ও তাদের ৮ অনুসারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা জানি, অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বুয়েটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। তাহলে এটা কেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে, মেধাবী এই শিক্ষার্থীদের এমন দানবে পরিণত করল?
এর আগে, ২০১৮ সালে আমরা ছাত্রলীগ ক্যাডারদের নিয়ে গঠিত 'হেলমেট' বাহিনীর তৎপরতা দেখেছি, বিশেষত নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুলশিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়। ওই সময়ে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা নিরাপদ সড়কের দাবি জানানোর অপরাধে স্কুলশিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার ও ধারাবাহিক হামলা চালায়। অথচ, এই দাবি এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও আমরা তাদের একই সহিংস রূপ দেখেছি।
সাধারণ মানুষ নিন্দা জানালেও এ ধরনের দুর্বৃত্তায়নের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রয়েছে এবং বিরোধীদের কোনো আন্দোলন বা সাধারণ শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী বা দেশের জনগণের যেকোনো ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বানচালের কাজে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ যখনই শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু নিয়ে বিক্ষোভ করে, তখনই ছাত্রলীগ ও 'হেলমেট বাহিনী' ব্যবহার করে তা দমন করা হয়।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রলীগের সদস্য কোনো শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে থাকতে পারতেন না। ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো, তখন পরিস্থিতি উল্টে গেলো এবং গত ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে তা অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে ক্ষমতার সব ধরনের অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে আবাসিক হলগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির হাতে চলে গেছে। হলে কে আসন পাবে আর কে পাবে না, সে বিষয়ের সিদ্ধান্তও এখন তাদেরই হাতে।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর থেকে শুধু ২টি দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দেশের ক্ষমতায় এসেছে এবং আমাদের শাসন করেছে। এই ২ দল আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করেছে তা হলো, বিরোধিতা ও ভিন্নমত দমন করার মানসিকতা এবং তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিরূপ আচরণ করা।
যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের রাজনৈতিক বলয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকরা সব ধরনের স্বীকৃতি, সম্মান, পদোন্নতি ও অর্থায়ন পেয়েছেন এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসীন করা হয়েছে। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো, তখনো একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো। তবে এবারের স্থায়িত্বকাল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ।
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের তালিকাই আমাদের এই ধারণাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। এসব ঘটনায় এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতা ও অবস্থান ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং আমরা তাদের রাজনীতিকরণ করেছি, যা এক অপূরণীয় ক্ষতি।
আবারও আমরা একটি নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছি এবং আবারও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব ধরনের ভুল সামনে চলে এসেছে। আমরা সবাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হয় সেটা জানি না। বিরোধীদলের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অন্যভাবে বলতে গেলে, তারা চায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিক, যা হওয়ার নয়। এখানেই আমরা আটকে আছি এবং খুব সম্ভবত এখানেই আটকে থাকব।
যেহেতু ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতি ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোনো নজির নেই, সেহেতু চলমান অচলাবস্থা আলোচনার টেবিলে নিরসনের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং পেশিশক্তি এবং সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক উপায়েই এর মীমাংসা হবে। যদি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছানো যেত, যার মাধ্যমে উভয় দল, বিশেষত বিরোধীদল শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের শর্তে তাদের সভা-সমাবেশ আয়োজন করতে পারত, তাহলে বিষয়টি সবার জন্যই মঙ্গলজনক হতো।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনাও বহু দূরে। বিএনপি যে দিন কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেয়, সেইদিনই আওয়ামী লীগও কর্মসূচির আয়োজন করে। এই বিষয়টি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, বিএনপির মতো নিজেদের শক্তিমত্তার প্রদর্শন করতে চায় আওয়ামী লীগও। বিষয়টি খুবই অযৌক্তিক এবং খুব সম্ভবত এমন মনোভাবের কারণেই সহিংসতা ও মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয় না। ইতোমধ্যে একজন নিহত হয়েছেন এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। অথচ, আওয়ামী লীগ যদি ভিন্ন কোনো দিনে তাদের কর্মসূচি পালন করত, তাহলে এমন ঘটনা এড়ানোর সুযোগ ছিল।
গণতন্ত্রে ফেরার ৩২ বছর পরে এসে আমাদের উচিত ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতা গড়ে তোলা। গণমাধ্যমকে দেশের 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ' করার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা হয় না। কিন্তু, তখন কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না, যখন আমাদের সবচেয়ে বড় ২ রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা না করে শুধু হুংকার দেয়, আপসের পরিবর্তে দোষারোপ করে, যেকোনো আলোচনা শুরুর আগেই শর্ত দিতে থাকে এবং বারবার প্রমাণ করে যে তাদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা এখনো তৈরি হয়নি? এই ছাড় দেওয়ার সক্ষমতা ও মানসিকতা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। এর অভাবে সমাজে শান্তি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক বিবর্তন হুমকির মুখে পড়ছে।
আমাদের জনগণের কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ছাড়া আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। তাই এর চেয়ে উন্নত জীবন আমাদের জনগণের প্রাপ্য।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments