‘পুরস্কারের জন্য দৌড়ঝাঁপ করলে লেখক বা শিল্পীর মৃত্যু ঘটে’

বাংলা একাডেমির আয়োজনে শেষ হচ্ছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। এখনো প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন নতুন বই। এবারের মেলায় সন্দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীবর 'সোফির জগৎ'। এবার তিনি অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার। গণঅভ্যুত্থান, নিজের লেখালেখি ও বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুবাদ নিঃসঙ্গতার একশ বছর। কতদিনের প্রস্তুতি ছিল, অভিজ্ঞতা জানাবেন
বইটি অনুবাদ করতে বছর পাঁচেক সময় লেগেছে। তবে টানা কাজ করিনি। পেশাগত ও পারিবারিক জরুরি কাজের চাপ ছিল। যাই হোক, নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে 'সন্দেশ' প্রকাশনী থেকে বইটি অনুবাদের জন্য আমাকে বলা হয়েছিল। যদিও অনুবাদের জন্য বই আমি নিজেই পছন্দ করি। 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড' একটা বিরল ব্যতিক্রম। অনুবাদ করার জন্য বইটি বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে। একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল অসংখ্য চরিত্রের নাম ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে।
যারা উপন্যাসটি পড়েছেন তারা জানেন নামগুলো বেশ কাছাকাছি, চট করে একটির সঙ্গে আরেকটির পার্থক্য করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, উপন্যাসটি যে-ভাষায় রচিত হয়েছিল সেই হিস্পানিক ভাষা আমি জানি না, আমার কাছে গ্রেগরি রাবাসার ইংরেজি তর্জমাই ছিল মূল টেক্সট। হিস্পানিক ভাষা কেবল দীর্ঘ বাক্যেই ভরপুর নয়, সেই সঙ্গে রয়েছে সে ভাষার অসাধারণ এক প্রবহমানতা, কোথাও গীতলতা, কোথাও গম্ভীরতা, কোথাও কৌতুকপরায়ণতা... সব মিলিয়ে নানা উপাদান ও উপাচারের এক মহাসম্মিলন। সেসব বাংলায় নিয়ে আসা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের, যা উপভোগ করেছি প্রতিটি বাক্যের অনুবাদ করতে গিয়ে।
একটি মৌলিক অনুবাদ করতে কোথায় কোথায় বাধা বা পারমিশন কীভাবে নিতে হয়, স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল কী?
এজন্য এজেন্ট বা প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। অনুবাদকের সঙ্গে তারা চুক্তি করেন না। করেন এ দেশের, মানে যেখানে কাজটা অনুবাদ হবে সেখানকার কোনো প্রকাশকের সঙ্গে। এটাই দস্তুর। ব্যতিক্রম যে একেবারেই নেই তা নয়। আর বাধা বলতে অনুবাদের কপিরাইটের উচ্চমূল্য। তবে সব বইয়ের কপিরাইটের জন্যই যে বেশি অর্থ দিতে হয় তা নয়, আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি করে অনেক সময় তা কমানোও যায়। তবে কখনো কখনো এতে অনেক সময় লেগে যায়। তাছাড়া এখানে যে অল্প পরিমাণ কপি ছাপা হয় তাতে বিদেশি প্রকাশকরা খুব একটা উৎসাহ পান না। তবে মাঝে মাঝে খুব কম টাকায়, কখনো কখনো একেবারে বিনে পয়সায় কপিরাইট দিয়ে দেন তারা।
শিক্ষকতা, লেখালেখি ও গবেষণা কোনটিকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য করেন, কেন?
শিক্ষকতা, লেখালেখি ও গবেষণা, উপভোগের ক্রমানুযায়ী সাজালে তা হবে- লেখালেখি, শিক্ষকতা ও গবেষণা। নিজের অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে লেখালেখিই বেশি পছন্দ, এরপর শিক্ষকতা। শিক্ষকতা পছন্দ এই কারণে যে, এই পেশায় পড়াশোনার অন্তর্গত ও বহির্গত দুই ধরনের চাপই থাকে, আর প্রতিবছর নতুন নতুন তরুণ প্রাণের সঙ্গে পরিচয় হয়, নবীনদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের বিপরীতে নিজেকে বিচার করা যায়, নিজের পর্যালোচনা করা যায়। গবেষণা তেমন করি না বললেই সত্য বলা হবে। গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ এবং উপভোগ্য নিশ্চয়ই। তবে আমি বুঝতে পেরেছি সেটা আমার জন্য নয়। আর সবাইকে, মানে (বিশ্ববিদ্যালয়ের) শিক্ষকদের সবাইকে গবেষণা কেন করতেই হবে, তা বুঝি না। যারা সৃজনশীল কাজে প্রাণের স্ফূর্তি লাভ করেন, তাদের ঘাড়ে গবেষণার জোয়াল কেন চাপাতে হবে, সেটা বুঝতে পারি না।
কাজের জন্য পুরস্কার বা স্বীকৃতির প্রয়োজন কি আছে, পুরস্কার পাওয়ার আগে ও পরে আলাদা কিছু অনুভব হয়?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলব, যারা নানা কাজ করেন তাদের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব এক কাপ চা বানিয়ে অন্যকে দিলেও লোক মনে মনে বা প্রকাশ্যে আশা করেন যে, সেই চা পান করে পানকারী যেন বলেন চা-টা কেমন হয়েছে, ভালো হয়েছে কি না। তবে স্বীকৃতির নানা ধরন আছে। পাঠক বা স্রোতার মনোযোগ পাওয়াও একটা স্বীকৃতি। পুরস্কার, বিশেষ করে মানসম্পন্ন কোনো পুরস্কার সেই স্বীকৃতির একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। জনসাধারণ সেই স্বীকৃতির কারণে একজন শিল্পীকে মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, শিল্পী যে সম্মানটা হয়ত তার পরিবারেও পেতেন না সেটা কিছুটা হলেও পান, তার ঘরে কিছু নগদ নারায়ণ আসে, সাধারণত যা তারা পান না, বিশেষ করে সাহিত্যিকরা। তবে লেখক বা শিল্পী যদি তার মূল কাজ ফেলে কেবল পুরস্কারের জন্যে ছোটেন, পুরস্কারমুখী হয়ে তা বাগাবার জন্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন, তাহলে সেই লেখক বা শিল্পীর এক ধরনের মৃত্যু ঘটে বলে মনে করি।
গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সমাজ রাষ্ট্রের সংকট মোকাবিলা একজন শিক্ষক কিভাবে করে?
যে কোনো পরিস্থিতিতে, সংকটে মানুষের আরচণের দুটো পথ আমার কাছে সবচাইতে গ্রহণীয় বলে মনে হয়। এক হচ্ছে কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করা (যদিও কাণ্ডজ্ঞান নাকি সবচাইতে বিরল বা দুষ্প্রাপ্য জ্ঞান) আর অন্যের প্রতি (ঠিক) তেমন আরচরণটি করা যা নিজের জন্য কামনা করি।
আমাদের বই ও বইমেলা কিভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির ভূমিকা রাখে?
কেবল বইমেলাতে বই প্রকাশ না করে আমাদের সারাবছর বই প্রকাশ করা উচিৎ। না হলে বইমেলার ক্ষণিক উত্তেজনার পর বই আমাদের মনোযোগ থেকে সরে যায়। কেবল বইমেলায় বই প্রকাশের মতো ক্ষণিক কিছু সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে না।
Comments