আ. লীগ ছাড় না দিলে ‘তারা’ কেন জিততে পারেন না?

জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু যে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছেন, তার বাইরে আর একটি আসনেও কি তাদের প্রার্থীরা জিতবেন?

নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের আসন থেকে যেদিন (১৭ ডিসেম্বর) জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের যুগ্ম মহাসচিব ছালাউদ্দিন খোকা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেন, সেদিনই ঢাকা-১৭ আসন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

তবে রংপুর–৩ আসন থেকে তিনি নির্বাচন করছেন। ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত। অর্থাৎ আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে যে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে একটা সমঝোতা হয়েছে, সেটি পরিস্কার।

প্রশ্ন হলো, এবার ভোটের মাঠে যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেই, ফলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সরে না দাঁড়ালে শামীম ওসমানের মতো একজন নেতার জয় পাওয়াটা কি কঠিন হতো? সহজ উত্তর হলো, না। ছালাউদ্দিন খোকার কাছে শামীম ওসমানের হেরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

কিন্তু তারপরও তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। কেন? শামীম ওসমানের জয়কে অধিকতর সহজ করার জন্য, নাকি ভোটের মাঠে জোট তথা সমঝোতার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য?

ঢাকা-১৭ আসনেও কি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আরাফাতের সঙ্গে লড়াই করলে জিএম কাদের জয়ী হতেন? এই আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোটের অনুপাত কেমন? উত্তরবঙ্গের কিছু আসন বাদ দিলে রাজধানীসহ দেশের অন্য এলাকাগুলোয় আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থা কি জাতীয় পার্টির আছে?

গত তিন মেয়াদে জাতীয় পার্টি মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছে। এককভাবে তারা শক্তিশালী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেনি। এবার তারা ২৮৩টি আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিলেও বিএনপি মাঠে থাকলে এই হিসাবটা পাল্টে যেতো। তখন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা সমঝোতার ভিত্তিতে গোটা তিরিশেক আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতেন।

যেহেতু বিএনপি নেই, অতএব তারা এককভাবে নিজেদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে ২৮৩টি আসনে ভোট করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তারাও জানেন, এর মধ্যে যে কয়টি আসনে আওয়ামী লীগ তাদের ছাড় দেবে, তার বাইরে একটি আসনেও তাদের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টির এককভাবে একটি শক্তিশালী দল হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, সেই পথে তারা হাঁটেনি।

তারা বরং একইসঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে থেকে 'গাছের উপরেরটা এবং তলারটা কুড়াতে' চেয়েছে। এভাবে ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে তথা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থেকে কোনো দল শক্তিশালী হতে পারে না। জাতীয় পার্টি হয়তো সেভাবে শক্তিশালী হতে চায়ওনি।

ফলে মাঝেমধ্যে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও; তাদের দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য হলেও এবং সেসব কারণে তাদের ভোটে আসা অনিশ্চিত মনে হলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি যে নির্বাচনে আসবে—সে বিষয়ে রাজনীতিসচেতন মহলের মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না।

বরং আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কতগুলো আসনের বিষয়ে ছাড় বা জয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, জাতীয় পার্টির এসব কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে যে আসলে সেটিই ছিল, সে বিষয়েও সংশয় কম। কেননা জাতীয় পার্টি বরাবরই নিজেদেরকে বিরোধী দল দাবি করলেও বা সাংবিধানিকভাবে তারা বিরোধী দল হলেও তাদের সামগ্রিক অবস্থান কখনোই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল না। বরং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে দলের শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীরই দ্বারস্থ হয়েছেন। তাতে অনেকের মনে এই প্রশ্নও তৈরি হয়েছে যে, জাতীয় পার্টি আসলে কার নির্দেশে চলে?

এবার জাতীয় পার্টির সংকট অবশ্য আগের দুটি নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন। এবার দলের বিভেদ বেশ স্পষ্ট। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের স্ত্রী—যিনি সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক—তিনি এবং তার ছেলে সাদ এরশাদ এবার নির্বাচনে নেই। নেই মানে তারা কোনো আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি। এই ইস্যুতে রওশন এরশাদ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দলের চেয়ারম্যান তথা তার দেবর জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে 'নালিশ' করেছেন—এমন সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে।

গত ১২ ডিসেম্বর ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে গণভবনে যান রওশন এরশাদ। বৈঠক থেকে বের হয়ে রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতা (রওশন) বলেছেন, আমরা যেহেতু তাদের (জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের) সঙ্গে নেই, তারা তাদের মতো নির্বাচন করুক, নির্বাচন উৎসবমুখর হোক। যদি জোট করতে হয়, আমাদের সঙ্গে আলাপ করে করবেন। কারণ আমরা জোটের ভাগিদার।'

গণমাধ্যমের খবর বলছে, রওশন তার নিজের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার জন্য রংপুর-১, ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদের জন্য রংপুর-৩, ময়মনসিংহ জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি কে আর ইসলামের জন্য ময়মনসিংহ-৬, রুস্তম আলী ফরাজীর জন্য পিরোজপুর-৩ সহ কয়েকটি আসন চেয়েছিলেন।

কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় রওশন ও সাদ এবার নির্বাচনে নেই। তবে মশিউর রহমান রাঙ্গা রংপুর-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। একইভাবে রুস্তুম আলী ফরাজিও পিরোজপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপদেষ্টা মাশরেকুল আজম রবি। তবে এখানে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নেই।

রুস্তুম আলী ফরাজীর জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে তার দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা এবং জিএম কাদেরের সঙ্গে দূরত্ব বলে জানা গেছে। তবে এখানেও দেবর-ভাবির টানাপোড়েনই মুখ্য বলে মনে করা হচ্ছে—যার সূত্রপাত আরও আগে।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরে ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছোট ভাই জি এম কাদের ২ জনই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন জি এম কাদের। উপরন্তু এই সময়ে তারা দুজনই সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হতে চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন। তখন রওশন ও কাদেরের মধ্যে একটা সমঝোতা হয় যে, রওশন হবেন বিরোধী দলীয় নেতা আর জি এম কাদের হবেন বিরোধী দলীয় উপনেতা ও দলের চেয়ারম্যান।

ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলে ৩ বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান হন জি এম কাদের। এরপর দলের নেতৃত্ব নিয়ে আরও নানা ধরনের নাটকীয়তা চলে—যার সবশেষ উদাহরণ এবারের নির্বাচনে স্বয়ং রওশন, সাদ, রাঙ্গা এবং রুস্তুম আলী ফরাজীর দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া।

এরকম বাস্তবতায় জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি শরিকদের আরও ৬টি আসনে ছাড় দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল—যারা নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবেন।

জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া আসনের মধ্যে রয়েছে রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম হায়দার পাটোয়ারী, পটুয়াখালী-১ আসনে রুহুল আমিন হাওলাদার, বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু।

আর ১৪ দলীয় জোট শরিকরা ছয়টি আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। তারা হলেন—পিরোজপুর-২ আসনে জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, বরিশাল-২ আসনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বগুড়া-৫ আসনে এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন (জাসদ), রাজশাহী-২ আসনে ফজলে হোসেন বাদশা (ওয়ার্কার্স পার্টি) ও লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে মোশারফ হোসেন (জাসদ)।

১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানান, জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে ভোটে অংশে নেবে। তার দাবি, 'কোনো জোট হয়নি। আসন সমঝোতাও হয়নি। তবে কিছু আসনের ক্ষেত্রে কিছু কৌশল রয়েছে।' প্রশ্ন হলো, যেহেতু রওশন এরশাদ মনোনয়নপত্র জমা দেননি এবং সেই সময়ই শেষ, তার মানে তিনি এবার ভোটের বাইরেই থাকছেন?

আওয়ামী লীগ যে আবারও সরকার গঠন করবে, সেটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। তাহলে কি জাতীয় পার্টিই ফের বিরোধী দল হতে যাচ্ছে? তখন বিরোধী দলীয় নেতা কে হবেন, জিএম কাদের? নাকি সরকারের বলয়ে থাকা অন্যান্য দলগুলো মিলে একটি সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন করবে?

রওশন এরশাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হলে ভোটের পরে তাকে কি কোনো আসন শূন্য করে উপনির্বাচনে জিতিয়ে আনা হবে? আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকা জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীরা যেহেতু নৌকা প্রতীকে ভোট করছেন, অতএব জয়ী হলে তারা সরকারি দলের এমপি হিসেবেই বিবেচিত হবেন। ফলে তাদের মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ আছে? নাকি এমন কিছু হবে যা এখন পর্যন্ত কারো চিন্তায় নেই?

জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু যে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছেন, তার বাইরে আর একটি আসনেও কি তাদের প্রার্থীরা জিতবেন? প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ ছাড় না দিলে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ এবং জাসদ ও ওয়ার্কার্স পাটির একজন প্রার্থীও জিতবেন না—এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? কেন এই দলগুলো এতদিনেও এককভাবে নির্বাচন করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারলো না? নাকি ক্ষমতার বলয়ে থাকতে থাকতে তারা দুর্বল হয়ে গেছে? অথবা তারা ধরেই নিয়েছে যে ভোটে জিততে হলে সমঝোতাই করতে হবে? এইসব ঘটনা কি বারবার দেশের মানুষকে এই বার্তাটিই দেয় যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প কিছু নেই?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments