জাতীয় পার্টির এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল?

‘এবারের নির্বাচনটি যে এরকম হবে, সেটি কি জাতীয় পার্টির নেতারা আন্দাজ করতে পারেননি? ভোটের পরদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জাতীয় পার্টির একজন নেতা অভিযোগ করেছেন, তারা এবার ভোটে অংশ নিতে চাননি। কিন্তু দলের অনেক নেতা তাদের ব্যবসা হারানোর ভয় এবং নানাবিধ চাপে ভোটে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’

বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা গ্রহণের পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি 'জাতীয় পার্টি' নামে যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তারা ওই বছরের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে।

এর দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই ভোট বর্জন করলে জাতীয় পার্টি 'ওয়াকওভার' পায় এবং ২৫১টি আসন নিয়ে তারা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু এরপর থেকে জাতীয় পার্টির আসন পাওয়ার সংখ্যা কমতে থাকে।

১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয়ী হয় ৩৫টি আসনে; ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পায় ৩২টি; ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করেও জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১৪টি আসন।

এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে ২৭টি; ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেটি আরও কমে দাঁড়ায় ২২ এ, যা অর্ধেকে নেমে এসেছে এবারের নির্বাচনে। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন—যা নিয়ে তাদের খেদের অন্ত নেই।

দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তাদেরকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভাষায়, 'সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিলেও কথা রাখেনি সরকার। সরকার যেখানে চেয়েছে সেখানে ভোট নিরপেক্ষ হয়েছে, যেখানে চায়নি সেখানে হয়নি।'

নানা সমীকরণ থাকলেও হয়তো জি এম কাদেরই সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসবেন। যদিও মাত্র ১১টি আসন নিয়ে বিরোধী দল হওয়া যায় কি না এবং এত কম সংখ্যক আসনে বিজয়ী দলের প্রধানকে বিরোধী দলীয় নেতা বলা যায় কি না, সেটি তর্কের বিষয়।

আমরা বরং খতিয়ে দেখতে চাই ধারাবাহিকভাবে জাতীয় পার্টির এই গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়া কি অবধারিতই ছিল? এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে? তার আগে এবারের ভোটের ফলাফলের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার জয়ী হলেও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টির এমপিদের মধ্যে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ফখরুল ইমাম, পীর ফজলুর রহমানসহ ১৪ জন হেরে গেছেন।

বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তার ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এবার নির্বাচন করেননি। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসন না পেয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। এর বাইরে রংপুরে মসিউর রহমান রাঙ্গা ও পিরোজপুরে রুস্তম আলী ফরাজি দল থেকে বাদ পড়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন। তারাও হেরেছেন।

জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরেও এবার তাদের অবস্থান খুব ভালো নয়। যেমন: রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে গেছেন; রংপুর-২, ৪, ৫ ও ৬ আসনেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। গাইবান্ধায় হেরে গেছেন জাতীয় পার্টির উঠতি নেতা এবং সংসদে ও টেলিভিশনে গঠনমূলক বক্তব্য দিয়ে আলোচিত শামীম হায়দার পাটোয়ারি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হলেও ঢাকায় হেরে গেছেন এবং জামানত হারিয়েছেন জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদের।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। কিন্তু এবারের ফলাফলে তাদের অবস্থা শোচনীয়।

কেন এমনটি হলো তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ আছে। যেমন: অনেকে মনে করছেন রংপুর-৩ আসনে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচন করলেও আশেপাশের আসনগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে দলের নেতাদের কর্মকাণ্ড ছিল না। মাঠপর্যায়ে কোনো ভূমিকা ছিল না। জি এম কাদেরের ভাতিজা রংপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন। তার মেয়াদকাল পার হওয়ার পর তিনি ওই এলাকায় যাননি। এবারের ভোটে তার অবস্থান তৃতীয়।

প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টির এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল? একটু পেছনে ফেরা যাক।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তারা একইসঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে ছিল। দশম সংসদের পুরো মেয়াদেই তারা 'সরকারি বিরোধী দল' বা 'গৃহপালিত বিরোধী দল' হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এর সপক্ষে যুক্তি দিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা সংসদে যা বলেছিলেন:

১. 'এটি একটি নতুন কনসেপ্ট। সরকারের মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির তিনজন মন্ত্রী থাকলেও বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করবো। আমরা সরকারের ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করবো এবং খারাপ কাজগুলোর সমালোচনা করবো।' (রওশন এরশাদ, ২৯ জানুয়ারি ২০১৪)

২. 'আমরা একইসঙ্গে সরকারে আছি আবার বিরোধী দলেও আছি। তার অর্থ এই নয় যে আমরা সরকারের সব কাজেই সমর্থন দিয়ে যাব। যদি আমরা মনে করি যে, সরকার কোনো জনবিরোধী কাজ করছে, তাহলে আমরা বিরোধী দল হিসেবে তার প্রতিবাদ তো জানাবই, এমনকি প্রয়োজনে সরকার থেকেও পদত্যাগ করব। অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ বর্জন না করে প্রয়োজনে আমরা ওয়াকআউট করব, আবার ফিরে আসব। লাগাতারভাবে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। নতুন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাই।' (মুজিবুল হক চুন্নু, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১?)

৩. 'বিরোধী দল মানে ফাইল ছুঁড়ে মারা নয়। জাতীয় পার্টি বিরোধী হিসেবে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়। আমরা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করব। উন্নয়নের অংশীদার হব।' (তাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২৩ মার্চ ২০১৪)

৪. 'জাতীয় পার্টি গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে এসে সংসদের ভেতরে ও বাইরে গঠনমূলক ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা করছে।' (মশিউর রহমান রাঙ্গা, ২৩ এপ্রিল ২০১৪)

৫. 'আগে সংসদে বিরোধী দলের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে সংখ্যায় সংসদ সদস্য কম হলেও জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় ভালো কাজ করবে।' (এইচ এম এরশাদ, ১৮ মে ২০১৪)

কিন্তু শেষদিকে এসে জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে কিছুটা গ্লানিবোধ পরিলক্ষিত হয়। কেননা একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরেই সমালোচনা ছিল।

একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সমালোচনা করে তোপের মুখে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির তৎকালীন কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ জন্য তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছিল।

এরকম বাস্তবতায় 'জাতীয় পার্টির সম্মান বাঁচাতে' প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ সংসদে বলেন, 'জাপার এমপিরা বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পান। কারণ, তারা সরকারি দল না বিরোধী দল সাংবাদিকরা তা জানতে চান।'

এ কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ হয়নি। তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকে। এমনকি সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে, বিশেষ করে এরশাদের মৃত্যুর পরে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব জি এম কাদেরের হাতে যাওয়ার পর থেকে। কেননা জি এম কাদের বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেছেন। এই সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বা দ্বিধা ছিল জি এম কাদেরের কণ্ঠে। যদিও পরবর্তীতে এটি পরিষ্কার হয়েছে যে, তিনি এই দ্বিধা বা সংশয় জিইয়ে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির জন্য দরকষাকষির জন্য।

দশম ও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টি যে ধরনের বিরোধী দলের আচরণ করেছে, সেখান থেকে তারা সরে আসতে চায় এবং জি এম কাদেরের অনেক বক্তব্য সরাসরি সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে। ক্ষমতাসীনরা হয়তো বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। যে কারণে এবার জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেওয়া হলেও এগুলো 'আনচ্যালেঞ্জড' ছিল না। কেননা হাতেগোনা কিছু আসন ছাড়া দেশের কোথাও এককভাবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার মতো সক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা নেই। বরং ১৯৮৬ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় পার্টি যে একক দল হিসেবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে, সেটি স্পষ্ট; যার পেছনে তাদের অনেক বেশি সরকারঘনিষ্ঠতা এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয়ত, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় জাতীয় পার্টির জন্য এবার এই সমঝোতা বেশ কঠিন ছিল। কেননা ভোটকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো এবং অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ তার দলের মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ খুলে দিলে জাতীয় পার্টি এবং মহাজোটের শরিক দলগুলোর জন্য আসন ভাগাভাগি কঠিন হয়ে যায়।

কেননা আওয়ামী লীগ নিশ্চিত হয়ে যায় যে তারা দুই শতাধিক আসনে জয়ী হবে। কিন্তু বিএনপি ভোটের মাঠে থাকলে সেটি যেহেতু আওয়ামী লীগের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করতো, ফলে সেই চাপ সামাল দিতে জাতীয় পার্টি এবং অন্য শরিক দলগুলোকে আরও বেশি আসন ছেড়ে দিতে হতো।

কিন্তু বিএনপি ভোটে না আসায় আওয়ামী লীগ যেহেতু অনেকটা 'ওয়াকওভার' পেয়ে যায়, সে কারণে কোনো আসনেই আওয়ামী লীগের নিজস্ব এবং মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলকে ছাড় দিতে রাজি হননি। ফলে জাতীয় পার্টি এবং শরিক দলগুলোকে নৌকার সঙ্গে না হলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। যে লড়াইটা পরোক্ষভাবে নৌকার সঙ্গেই।

বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে যেমন প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে একইভাবে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। এর একটি বড় কারণ জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঠিক 'সরকারি বিরোধী দল' কিংবা ক্ষমতাসীনদের অনুগত বলে বিবেচিত হচ্ছে না। অর্থাৎ এরশাদ বা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি যতটা আওয়ামী লীগের অনুগত ছিল, জি এম কাদের সেই আনুগত্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সক্ষমতা তার দলের নেই। তার বড় কারণ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

এরশাদের মৃত্যুর পরে দলের নেতৃত্ব নিয়ে 'দেবর-ভাবির টানাপোড়েন' ওপেন সিক্রেট হয়ে যায়। দলের ভেতরে রওশনপন্থি এবং কাদেরপন্থি গ্রুপ তৈরি হয়ে যায়। ফলে এরকম একটি দ্বিধাবিভক্ত দল আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় ও শক্তিশালী দলের সঙ্গে দর কষাকষি করে যে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না, সেটিই স্বাভাবিক।

উপরন্তু এবারের নির্বাচনে খুব কৌশলে রওশন এবং তার ছেলে সাদকে বাইরে রাখা হয়েছে—যা নিয়ে রওশন এরশাদ নিজে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে 'নালিশ' করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। ফলে দলের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দাপট এবং গত তিন মেয়াদে জাতীয় পার্টির সরকারঘনিষ্ঠতা তথা দুই নৌকায় পা দেওয়া; কিছুদিন পরপর একেকটা ইস্যুতে হাস্যরসের জন্ম দেওয়ার মধ্য দিয়ে দলের দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়েছে—যা ভোটারদের মধ্যে দারুণ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়।

জি এম কাদের এখন বলছেন, 'সরকার কথা রাখেনি'। প্রশ্ন হলো, সরকার বা আওয়ামী লীগ কি তাদেরকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়ে এ কথা বলেছিল যে এখানে তাদের সব প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা চ্যালেঞ্জে জিতিয়ে আনা হবে? ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেমন ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা হয়ী হয়েছিলেন, এবারের নির্বাচন যে সেরকম হবে না, এটি আওয়ামী লীগ তরফে শুরু থেকেই বলা হচ্ছিলো।

ফলে জাতীয় পার্টিকে যে এরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে এবং দীর্ঘদিন সরকারি বা অনুগত বিরোধী দল হিসেবে সার্ভিস দেওয়ার পরেও যে তাদের এমন শোচনীয় পরাজয় হবে, সেটি হয়তো তাদের ভাবনায়ও ছিল না। ছিল না বলেই দলের নেতারা এখন বলছেন, ভোট সুষ্ঠু হয়নি। তাদের ২৬ জনই যদি জয়ী হতেন, তাহলে কি তারা বলতেন যে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে?

এবারের নির্বাচনটি যে এরকম হবে, সেটি কি জাতীয় পার্টির নেতারা আন্দাজ করতে পারেননি? ভোটের পরদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জাতীয় পার্টির একজন নেতা অভিযোগ করেছেন, তারা এবার ভোটে অংশ নিতে চাননি। কিন্তু দলের অনেক নেতা তাদের ব্যবসা হারানোর ভয় এবং নানাবিধ চাপে ভোটে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

যদি তাই হয়, তাহলে বলতে হবে জাতীয় পার্টির এই পরিণতি অবধারিতই ছিল। তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল কী হবে এবং দলটি ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হবে কি না, সেটি নির্ভর করবে দ্বাদশ সংসদে তাদের কার্যক্রমের ওপর।

 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments