শিশুর উদ্বেগের কারণ ও লক্ষণ কী, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন কখন

সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্য ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ইতিবাচক দক্ষতা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুদের উদ্বেগ নিরাময়যোগ্য।
ছবি: সংগৃহীত

বন্ধুত্ব, অনেক মানুষের সামনে কথা বলা বা পরীক্ষা দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে মাঝে মাঝে শিশুদের চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের দুশ্চিন্তা যখন ক্রমাগত আসতেই থাকে এবং দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে তখন উদ্বেগ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবে সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্য ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ইতিবাচক দক্ষতা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুদের উদ্বেগ নিরাময়যোগ্য।

চলুন জেনে নিই এ বিষয়ে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ কী বলছে—

উদ্বেগ কী

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, উদ্বেগ হলো সেই অনুভূতি যা আপনি কোনো বিষয়ে চিন্তিত বা ভীত হলে অনুভব করেন। এটি ভয় বা আতঙ্কের একটি স্বাভাবিক ও মানবিক অনুভূতি। তবে এমন অনুভূতির পর আমরা সাধারণত শান্ত হই এবং ভালো বোধ করি।

সামান্য দুশ্চিন্তা ও ভয় আমাদের নিরাপদ রাখতে এবং এমনকি বিপদ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে। তবে কখনও কখনও উদ্বেগের কারণে পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে যে অবস্থায় আছে, আমাদের কাছে তার চেয়েও খারাপ মনে হতে পারে এবং তা আমাদের হতবিহ্বল করে দিতে পারে। ক্রমাগত দুশ্চিন্তা দীর্ঘাস্থায়ী উদ্বেগেরও কারণ হতে পারে।

যদি উদ্বেগ আপনার সন্তানকে এমন কাজগুলো করতে বাধা দেয়, যা তারা উপভোগ করে অথবা সে এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত বোধ করে যা মানসিক চাপযুক্ত নয়, তাহলে তারা যাতে ভালো অনুভব করতে পারে সেজন্য সহায়তা পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্বেগের কারণ কী

উদ্বেগের সঠিক কারণগুলো চিহ্নিত করা কঠিন হতে পারে। যখন আমরা মানসিক চাপযুক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তখন আমাদের মস্তিষ্কে সতর্কতার ঘণ্টা বাজতে থাকে, যা আমাদের বলে যে কিছু একটা ঠিক নেই এবং আমাদের তা মোকাবিলা করতে হবে। কঠিন পরিস্থিতি দূর করার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের আরও সতর্ক করে তোলে, আমাদের অন্য জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করা থেকে বিরত রাখে, এমনকি পালাতে সাহায্য করার জন্য আমাদের পায়ে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়।

শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগ

শিশুরা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বেগ অনুভব করতে পারে। এই দুশ্চিন্তার অনেকগুলোই বেড়ে উঠার একটি স্বাভাবিক অংশ।

৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তারা সবসময় তাদের বাবা-মা বা যত্নকারীদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে এবং তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে কান্না করতে পারে। এটি একটি শিশুর বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক পর্যায়। তবে তাদের বয়স ২ থেকে ৩ বছর হয়ে গেলে এটি বন্ধ হওয়া উচিত।

প্রাক-স্কুল-বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাণী, পোকামাকড়, ঝড়, উচ্চতা, পানি, রক্ত ও অন্ধকারসহ নির্দিষ্ট কিছু নিয়ে ভয় বা আতঙ্ক তৈরি হওয়াও সাধারণ ঘটনা। এই ভয়গুলো সাধারণত ধীরে ধীরে নিজে থেকেই চলে যায়।

অনেক শিশু নতুন স্কুলে যাওয়ার সময় বা পরীক্ষার আগে উদ্বিগ্ন বোধ করে। কিছু শিশু সামাজিক পরিস্থিতিতে লাজুক বোধ করে।

যদি আপনার শিশু সাধারণ ভয় ও উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে না পারে, অথবা এটি যদি স্কুল বা বাড়িতে বা খেলাধুলায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তাহলে এর অর্থ হতে পারে তাদের একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন।

মনে রাখবেন, শুধু একজন চিকিৎসক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্ণয় করতে পারেন। তাই আপনি যদি আপনার সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত হন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর কাছে পরামর্শ চাইতে দ্বিধাবোধ করবেন না।

শিশুদের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ ও উপসর্গ

উদ্বেগের লক্ষণগুলো জটিল হতে পারে এবং এমনকি কোনো মানসিক চাপপূর্ণ ঘটনার অনেক পরেও এটি দেখা দিতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে-

শারীরিক-

শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা বা জ্ঞান হারানো

হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং কখনও কখনও উচ্চ রক্তচাপ

অস্থিরতা, কাঁপুনি বা পায়ে দুর্বল বোধ করা

পেটে অস্বস্তি বোধ করা– ব্যথা, ডায়রিয়া বা ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া

ঘুমের সমস্যা হওয়া বা ক্ষুধা কমে যাওয়া

মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া বা গরম অনুভব করা

আবেগীয় ও মানসিক-

কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে সমস্যা হওয়া, একাগ্রতার অভাব

আতঙ্কিত হওয়া বা ধ্বংসের প্রান্তে চলে যাওয়ার অনুভূতি

হতবিহ্বল বা ভয়ঙ্কর অনুভূতি

একটি পরিস্থিতিতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে মনে হওয়া

ক্লান্ত ও খিটখিটে ভাব

উদ্বেগ একেকজনের কাছে একেকভাবে অনুভূত হয়। একই পরিস্থিতিতে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম উদ্বিগ্ন বোধ করা স্বাভাবিক।

উদ্বিগ্ন শিশুদের তাদের বাবা-মা ও যত্নকারীদের কাছ থেকে ক্রমাগত আশ্বাসের প্রয়োজন হয়। কারণ তারা এ অনুভূতিগুলো চাপিয়ে রাখতে পারে এবং তাদের অবস্থা সহজেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। উদ্বেগের লক্ষণগুলোর প্রতি সতর্ক থাকুন, যাতে প্রয়োজন হলে আপনি দ্রুত আপনার সন্তানের জন্য সাহায্য ও সেবা নিতে পারেন।

আপনার সন্তানকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করার উপায়

আপনার সন্তান যদি উদ্বিগ্ন বোধ করে, তাহলে আপনি প্রথমে যা করতে পারেন তা হলো তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে এই অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী। এটি তাদের শান্ত হতে এবং কম উদ্বিগ্ন বোধ করতে সহায়তা করবে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং আরও ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে তাদের সহায়তা করতে আপনি নিচের কাজগুলো করতে পারেন-

একসঙ্গে অনুভূতিটি সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করুন

আপনার সন্তানকে তাদের উদ্বেগের অনুভূতিগুলো পর্যবেক্ষণ করতে বলুন এবং জানার চেষ্টা করুন– যখন তারা উদ্বিগ্ন বোধ করে তখন কী ঘটতে থাকে, তাদের কেমন লাগে, অনুভূতিটি কতক্ষণ স্থায়ী হয় এবং উদ্বিগ্ন বোধ করার কারণ কী হতে পারে? তারা যত বেশি অনুভূতিটি বুঝতে পারবে ও নিরাপদ বোধ করবে, এটি সামাল দেওয়া তত সহজ হবে।

লক্ষ্য পরিবর্তন করুন

অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে উদ্বিগ্ন শিশুরা প্রায়শই নিজেদের এমন প্রশ্ন করে যে প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারে না, যেমন 'কেন এমন হচ্ছে?' বা 'আমার সঙ্গেই কেন হচ্ছে?'।  এ সময় 'তুমি রাতের খাবারে কী চাও?' এ ধরনের প্রশ্ন তাদের নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে এবং বর্তমানে মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে।

স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করুন

ভালো ঘুম ও খাবার ইতিবাচকভাবে উদ্বিগ্ন অনুভূতিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে উদ্বিগ্ন বোধ করার পর আমরা প্রায়ই ক্লান্ত বোধ করি। বিশেষজ্ঞরা ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য রাতে ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেন। কিশোর-কিশোরীদের রাতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমের সময় ঠিক রাখতে রাতে ডিজিটাল স্ক্রিনে কাটানো সময় সীমিত করুন এবং বেডরুমে ডিজিটাল ডিভাইস রাখা পরিহার করুন।

তাদের ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন

আতঙ্ক, উদ্বেগ ও মানসিক চাপের অনুভূতি মোকাবিলা করতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো শক্তিশালী হাতিয়ার। আপনার সন্তানকে সেগুলো ব্যবহার করতে উৎসাহিত করার জন্য এখানে একটি সহজ উপায় রয়েছে-

আপনার সন্তানকে স্বচ্ছন্দে বসতে বলুন এবং ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে ও ছাড়তে বলুন। এখন তাদের যন্ত্রণাদায়ক নয় এমন কিছু জিনিসের নাম বলতে বলুন তারা দেখতে পারে এমন ৪টি জিনিস, তারা শুনতে পারে এমন ৩টি জিনিস, তারা গন্ধ নিতে পারে এমন ২টি জিনিস এবং তারা স্বাদ নিতে পারে এমন একটি জিনিস।

পেটে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করুন

যখন আমরা উদ্বিগ্ন থাকি তখন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস অগভীর হয়, নিঃশ্বাসের বাতাসে বুক ফুলে উঠে এবং আমরা গভীরভাবে শ্বাস নিতে (পেট ফুলে উঠবে) ভুলে যাই। গভীর শ্বাস খুবই প্রশান্তিদায়ক এবং এটি আমাদের ফুসফুসের গভীরে অক্সিজেন সরবরাহে সাহায্য করে।

এখানে ৩ ধাপের একটি সহজ প্রক্রিয়া দেওয়া হলো-

আপনার পেটে হাত রাখুন

৫টি গভীর শ্বাস নিন, ৫ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন এবং ৫ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়ুন, আপনার নাক দিয়ে শ্বাস নিন এবং মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন।

বুঝিয়ে বলুন যে আপনার শিশু যখন শ্বাস নেয়, তখন তারা একটি বেলুনের মতো নরমভাবে তাদের পেট ফোলায় এবং যখন তারা বাতাস ছাড়ে তখন আবার বেলুন থেকে ধীরে ধীরে বাতাস বের হয়।

কখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে

যদি উদ্বেগ আপনার সন্তানের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া একটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করতে পারে। চিকিৎসার বিষয়টি পর্যালোচনা করা ও পরামর্শ প্রদানের জন্য আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী আপনাকে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে পারেন। আপনার সন্তানকে যদি কাউন্সেলিং বা কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাহলে তারা কেমন অনুভব করছে এবং মানিয়ে নেওয়ার উপায়গুলো কী সে সম্পর্কে একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।

একজন অভিভাবক হিসেবে এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনার সন্তানের উদ্বেগের অনুভূতি আপনার অভিভাবকত্বের প্রতিফলন নয় এবং আপনার সন্তান উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এমনটি করছে না। এটি একটি মানসিক চাপযুক্ত গুরুতর পরিস্থিতি এবং আপনার মনোযোগ, ভালবাসা ও যত্নের মাধ্যমে উদ্বেগ সামাল দেওয়া ও কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

তথ্য: ইউনিসেফ

 

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

2h ago