ঘুরে আসুন কবি মধুসূদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত মধুপল্লী

মধুপল্লী

যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি। এই নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মুখ। এই গ্রামেই জন্মেছেন কবি মধুসূদন দত্ত। কবির পৈত্রিক বাড়ি ও তার স্মৃতি বিজড়িত স্থান জুড়ে গড়ে উঠেছে মধুপল্লী।

মধুপল্লীর ইতিহাস

১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সাগরদাঁড়িতে জন্ম নেন মধুসূদন দত্ত। শৈশবের একটি বড় সময় তিনি এই গ্রামেই কাটান। যদিও কৈশোরে কলকাতায় পাঠানো হয় শিক্ষার জন্য, তবু শেকড় ছিল এখানেই।

মধুপল্লী

১৮৬২ সালে কলকাতায় থাকাকালীন মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে কবি আবার আসেন সাগরদাঁড়িতে। পরে সেখান থেকে আবারও কলকাতায় চলে যান। এরপর কোনোদিন কবি মধুসূদন দত্ত আর এ বাড়িতে ফিরে আসেননি।

কিন্তু জন্মস্থানের প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে এখানকার প্রকৃতি, জীবন ও কপোতাক্ষ নদ তার কবিতায় ফিরে এসেছে বারবার। শুধু তাই না, তার সাহিত্যবোধ ও রোমান্টিক ভাবনার পেছনে সাগরদাঁড়ির প্রভাব অগ্রাহ্য করার নয়।

আর সাগরদাঁড়ির এই জনপদ ঘিরেই পরে গড়ে ওঠে মধুপল্লী। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় কবির স্মৃতি নিদর্শন এবং আলোকচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘর।

কবির ছায়া

মধুপল্লীর মূল ভবনটি দুই তলা। পুরোনো দিনের টালির ছাদ, লাল ইটের দেয়াল, কাঠের দরজা-জানালা আপনাকে সেই সময়ের স্মৃতি দর্শনের সুযোগ দেবে।

দোতলা ভবনটির ওপর তিনটি ও নিচে তিনটি কক্ষ মিলে মোট ছয়টি কক্ষ রয়েছে। নিচতলায় রয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত জাদুঘর। যেখানে সংরক্ষিত আছে কবির ব্যবহৃত পালঙ্ক, চেয়ারে বসানো তার প্রতিকৃতি, চিঠিপত্র, পোশাক, প্রথম সংস্করণের কাব্যগ্রন্থ, তার হাতে লেখা ইংরেজি ও বাংলা চিঠির কপি, পারিবারিক কাগজপত্র, এমনকি মাদ্রাজের সময়কার কিছু নিদর্শনও।

এই ভবনের একদম উত্তর দিকে রয়েছে ছাদহীন-দেয়ালঘেরা একটি অসাধারণ নির্মাণশৈলীর কক্ষ। এছাড়া বাড়িটির প্রবেশ পথের একদম সামনেই রয়েছে কবি মধুসূদন দত্তের একটি ভাস্কর্য। ভাস্কার্যটি ১৯৮৪ সালে শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র বিশ্বাস নির্মাণ করেন।

মধুপল্লীতে আরও যা যা দেখার আছে

রন্ধনশালা ও অতিথিশালা

মূল ভবনের পেছনেই দেখা মেলে একটি রন্ধনঘরের। এটি ইট আর চুনের মিশেলে গড়া। এর পাশেই রয়েছে অতিথিশালা, যেখানে জমিদার পরিবার অতিথি আপ্যায়ন করত। এটি এখন উন্মুক্ত।

মধুপল্লী

বাগান ও আঙিনাজুড়ে গাছ-গাছালি এবং পুকুর

কবি মধুসূদন দত্তের পুরো বাড়ির চারপাশজুড়ে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল ও পাম গাছ। বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি বৃহৎ পুকুর। পুকুরের পাশে বসে এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যেতে পারেন।

পাঠাগার ও স্মৃতিফলক

মূল ভবনের পাশেই ছোট একটি ঘরে রয়েছে পাঠাগার। যেখানে রয়েছে কবির বইয়ের সংগ্রহ। কবি মধুসূদন দত্তের লেখা ও তাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ। পাঠাগারের পাশেই রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। যেখানে খোদাই করে লেখা কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি, যা থেকে পর্যটকরা কবির ইতিহাস জানবেন।

কপোতাক্ষ নদ ও কাঠবাদাম গাছ

বাড়ির পেছন দিকেই কপোতাক্ষ নদের প্রবাহ। কপোতাক্ষ নদের তীরে এখনও কবির স্মৃতি বিজড়িত কাঠবাদাম গাছ আছে। যদিও বয়সের ভারে গাছটি মৃতপ্রায়। দখল, দূষণে কপোতাক্ষ নদও আজ তার জৌলুশ হারিয়েছে। তবে তা এখনও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

সাংস্কৃতিক মঞ্চ ও উৎসব চত্বর

জাদুঘরের পাশে নির্মিত হয়েছে একটি স্থায়ী মঞ্চ, যেখানে প্রতি বছর মধুমেলার সময় সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়। কবিতা পাঠ, নাটক ও আলোচনায় মুখর থাকে এই অংশটি।

মধুপল্লী

শেখ পাড়া জামে মসজিদ

মধুপল্লী থেকে ফেরার পথে একটু ঘুরে গেলে দেখা মিলবে শেখ পাড়া জামে মসজিদ। এটি মুঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২১.৫ মিটার ও প্রস্থ ১৬.৬ মিটার।

মধুমেলা

প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কবি মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকীতে এ মধুপল্লীতে আয়োজন করা হয় মধুমেলার। দেশ-বিদেশের কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্য অনুরাগীরা এসে যোগ দেন এই আয়োজনে। চলে আলোচনা, কবিতা পাঠ, নাটক, গ্রামীণ মেলা, বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উৎসবজুড়ে পুরো সাগরদাঁড়ি রূপ নেয় এক সাহিত্যিক প্রাণচাঞ্চল্যে। তাই এখানে ঘুরতে আসার উপযুক্ত সময় মধুমেলার সময়।

সময়সূচি ও প্রবেশমূল্য

মধুপল্লী সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রোববার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। মধুপল্লীতে প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। তবে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা।

ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন

এখানে আসতে হলে আপনাকে প্রথমেই যশোর আসতে হবে। যশোর সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মধুপল্লী। যশোর থেকে বাসে এসে কেশবপুর নামতে হবে। বাস ভাড়া ৫০ টাকা ও অটোরিকশা ভাড়া জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা। এরপর স্থানীয় যানবাহন রিজার্ভ করে সাগরদাঁড়ির এই মধুপল্লীতে যেতে হবে।

যেখানে থাকবেন

মধুপল্লীতে রাতে থাকার মতো ভালো কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তাই থাকতে হলে যশোর শহরে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানে যশোর সার্কিট হাউজসহ বেশকিছু সরকারি/বেসরকারি রেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল রয়েছে। এগুলোতে ৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকার মধ্যে থাকা যায়।

যা খাবেন

যশোরের খেজুরের গুড় খুবই বিখ্যাত। তাই খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ ও ভিজা পিঠা খেতে ভুলবেন না। এছাড়া হাতে সময় থাকলে খেতে পারেন জামতলার মিষ্টি, ধর্মতলার চা ও চুকনগরের বিখ্যাত চুইঝাল।

ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

 

Comments